[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

১১ কিলোমিটার দূরের ডোবায় পাওয়া গেল ঋত্বিক ঘটকের বাড়ির ইট

প্রকাশঃ
অ+ অ-
চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের বাড়ির ইট পাওয়া গেছে পবা উপজেলার খড়খড়ি বাইপাস এলাকায় শাহমখদুম নার্সিং কলেজের পাশে এক পুকুরে। বুধবার বিকেলে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

ডোবাটির অবস্থান রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে। সেখানে পড়ে আছে পুরোনো ইট ও ভাঙা দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ। অল্প দূরে আরেকটি পুকুরপাড়ে দেখা মিলল আরও দুটি ইটের স্তূপ। ইটগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলেন এক সংস্কৃতিকর্মী। হঠাৎ তিনি ভারী নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এগুলো তো ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক ভিটার ইট।’

কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের রাজশাহীর বাড়ির ধ্বংসাবশেষ থেকে ইট সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে গত মঙ্গলবার, বিজয় দিবসের প্রাক্কালে। অভিযোগ, ট্রাকে করে ইটগুলো তুলে নিয়ে পুকুর ও ডোবায় ফেলা হয়। রাজশাহীর চলচ্চিত্রকার ও সংস্কৃতিকর্মীরা এতে বাধা দিলে প্রশাসন ইট সরানোর কাজ বন্ধ করে দেয়। তখন থেকেই প্রশ্ন—ইটগুলো গেল কোথায়? অনেকে ইটের সন্ধান করতে থাকেন।

এর আগে ট্রাকচালক মো. ওয়াজ জানিয়েছেন, ইটগুলো ‘পুকুরে আর রাস্তায়’ ফেলা হয়েছে। এরপর তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। গত বুধবার বিকেলে তার সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়। তিনি জানান, পবা উপজেলার খড়খড়ি বাইপাসের পাশে, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে একটি পুকুরে এক ট্রাক ইট ফেলা হয়েছে। সেই তথ্য ধরে বিকেলে সেখানে গিয়ে সত্যিই পাওয়া যায় ঋত্বিক ঘটকের বাড়ির ইট। তিনি আরও বলেন, আরও দুই ট্রাক ইট ফেলা হয়েছে রাজশাহী নার্সিং কলেজের পাশের একটি পুকুরে। সেখানেও ইটের অস্তিত্ব মিলেছে।

ট্রাকচালক মো. ওয়াজ বলেন, ‘কবির নামে একজনের সঙ্গে কলেজের স্যারদের চুক্তি হয়েছিল। কবির চাচার দেখানো জায়গায় আমি এগুলো ফেলেছি। বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে একটি ডোবায় এক ট্রাক, নার্সিং কলেজের পাশে দুই ট্রাক। আরও একজন চালক এক ট্রাক ফেলেছে, তবে সে কোথায় ফেলেছে, তা জানি না।’

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে ছিলেন রাজশাহী ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির নির্বাহী সদস্য আতিকুর রহমান। তিনি ইটগুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছিলেন। চোখে-মুখে ক্ষোভ আর আক্ষেপ নিয়ে বললেন, ‘একজন কিংবদন্তির বাড়ি ভেঙে ফেলা হলো। এরপর তার ইটগুলো লুকিয়ে ফেলা হলো পুকুর আর ডোবায়। এভাবেই কি ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলা হবে?’ তিনি আরও বলেন, ‘পুকুর ভরাট করাও আইনত অপরাধ। প্রশাসন আসলে কী করছে, সেটাই প্রশ্ন।’

ঋত্বিক ঘটক জীবনের শুরুর সময় কাটিয়েছেন রাজশাহীর মিঞাপাড়ার পৈতৃক বাড়িতে। এখানে থাকার সময় তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন। রাজশাহী কলেজ ও মিঞাপাড়ার সাধারণ গ্রন্থাগার মাঠে কালজয়ী কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নাট্যচর্চা করেছেন। ওই সময় ‘অভিধারা’ নামে সাহিত্যের কাগজও সম্পাদনা করেছেন। তখন রাজশাহীতে সাহিত্য ও নাট্য আন্দোলন বেগবান হয়। এ বাড়িতে থেকেছেন তার ভাইঝি, বরেণ্য কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী।

রাজশাহীর মিঞাপাড়ায় অবস্থিত ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ভেঙে ফেলা হয়। ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে পাশের রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে। তবে কলেজ কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল, তাদের কিছু প্রাক্তন শিক্ষার্থী এই কাজ করেছেন। ঘটনার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও এখন পর্যন্ত তার সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।

বাড়িটির ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার বাড়ির ৩৪ শতাংশ জমি রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজকে ইজারা দেয়। ২০১৯ সালে বাড়ির একাংশ ভেঙে সেখানে সাইকেল গ্যারেজ নির্মাণের চেষ্টা হলে দেশজুড়ে প্রতিবাদের সৃষ্টি হয়। ২০২০ সালে জেলা প্রশাসন বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। তৎকালীন সরকারের একজন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী স্থানটি পরিদর্শন করে সংরক্ষণের আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।

বাড়িটি ভেঙে ফেলার পর ধ্বংসাবশেষের ইটগুলো সেখানে স্তূপ করে রাখা হয়। গত দুই বছর ধরে ৪ নভেম্বর ঋত্বিক ঘটকের জন্মবার্ষিকীতে রাজশাহীর সংস্কৃতিকর্মীরা ওই ইটের ওপর মোমবাতি জ্বালিয়ে স্মরণ অনুষ্ঠান করে আসছেন। চলতি বছর এখানে ঋত্বিক ঘটকের জন্মশতবর্ষও পালন করা হয়।

ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি আহসান কবির লিটন বলেন, ‘ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধ্বংস করা হত্যাযজ্ঞের চেয়ে কম অপরাধ নয়। এই ইটগুলো শুধু নির্মাণসামগ্রী নয়, এগুলোর ঐতিহাসিক ও শিল্পমূল্য আছে।’ তিনি বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগে বলা হয়েছিল, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত ধ্বংসাবশেষ যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকবে। তারপরও ট্রাকে করে ইট তুলে নিয়ে যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না।

ইট সরানোর ব্যাপারে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান বলেন, ইট সরানোর সিদ্ধান্ত কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে।

ইটগুলো পুকুরে ও ডোবায় ফেলার ব্যাপারে রাজশাহী জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) এবং কলেজের সভাপতি টুকটুক তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। তবে মঙ্গলবার তিনি পুকুরে ইট ফেলার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘পুকুরে ফেলা হয়নি। জায়গাটা পরিষ্কার করার জন্য সাময়িকভাবে সরানো হচ্ছিল।’

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন