[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

সচিবের বাড়ির কবরস্থান উন্নয়নে সরকারি বরাদ্দ ২৪ লাখ টাকা

প্রকাশঃ
অ+ অ-

আটটি প্রকল্পের মাধ্যমে চলছে সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর পারিবারিক কবরস্থানের উন্নয়নকাজ। সম্প্রতি ময়মনসিংহের ফুলপুরের নিজ আশাবট গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নিজ আশাবট। এই গ্রামের একটি কবরস্থানের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, উন্নয়ন এবং সুপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করার নামে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আটটি ছোট প্রকল্প নিয়েছে জেলা পরিষদ। বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মোট ২৪ লাখ টাকা।

কাগজে-কলমে কবরস্থানটিকে ‘সামাজিক কবরস্থান’ হিসেবে দেখানো হলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এটি স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর পারিবারিক কবরস্থান।

ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন সরদারের ইচ্ছায় এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জেলা পরিষদ সূত্র বলছে, স্থানীয় সরকার সচিবকে সন্তুষ্ট রাখতে কবির হোসেন এই কাজ করেছেন।

এক কবরস্থানের জন্য আটটি প্রকল্প গ্রহণ, কম্বল বিতরণে অনিয়ম, জেলা পরিষদের প্রশাসকের স্বাক্ষর জালিয়াতিসহ মো. কবির হোসেনের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তুলেছেন জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গত ২৬ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। এরপর ২৭ অক্টোবর তাঁকে ময়মনসিংহ থেকে বদলি করে পটুয়াখালী জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা করা হয়। পরে ২ নভেম্বর নতুন আদেশে তাঁকে নেত্রকোনা জেলা পরিষদে বদলি করা হয়।

স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি কখনো কবরস্থানে প্রকল্প দিতে বলিনি। সেখানে মানুষের জন্য পানি ও একটি পাঞ্জেখানা মসজিদের (যে মসজিদে জুমা ছাড়া পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয়) জন্য বলেছিলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি ছোট কাজের কথা বলেছি, কিন্তু জেলা পরিষদ তা ভুলভাবে করে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এখন আমি এটি বন্ধ করতে বলেছি।’

সচিব বলেন, বিষয়টি জানার পরই তিনি কবির হোসেনকে বদলির নির্দেশ দিয়েছেন। শুরুতে তাঁকে পটুয়াখালী বদলি করা হলেও পরে নেত্রকোনায় পাঠানো হয়। নেত্রকোনাতেও সাংবাদিকেরা আপত্তি জানাচ্ছেন। তাঁকে নতুন জায়গায় বদলি করা হবে।

নথি দেখে জানা গেছে, ২০১৩ সালে সাভারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন কবির হোসেন সরদার। তখন তাঁর বিরুদ্ধে দুই ভাইয়ের নামে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি পোশাক কারখানার শেয়ার কিনে সেটি দখলের অভিযোগ ওঠে। উত্তরার একটি ফ্ল্যাটে ১১ মাস বসবাস করেও ভাড়া না দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এই অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ২০১৫ সালে বিভাগীয় শাস্তি হিসেবে তাঁর বেতন কমিয়ে দুই ধাপ অবনমিত করা হয়।

ছোট কাজ করতে বললাম, আর জেলা পরিষদ ভুলভাবে এটা করে বিশ্রী অবস্থা করেছে। আমি এখন এটি বাদ দিতে বলেছি।

— স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী

জেলা পরিষদ সংবিধিবদ্ধ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। এটি স্থানীয় সরকার বিভাগের জারি করা পরিপত্র দিয়ে পরিচালিত হয়। জেলা পরিষদের নিজস্ব বাজেট আছে, যার মাধ্যমে বিভিন্ন ছোট প্রকল্প ও অনুদানমূলক কাজ করা হয়। তবে এসব কাজে স্বজনপ্রীতি, প্রভাবশালীদের ইচ্ছাপূরণ এবং দুর্নীতির অভিযোগও ওঠে।

ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের নথিপত্র দেখে জানা যায়, গত ১৮ মে জেলা পরিষদের তৎকালীন প্রশাসক ও অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার জিয়া আহমেদ সুমনের সভাপতিত্বে একটি সভা হয়। সভায় স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে পাওয়া ৯০ লাখ টাকার বিপরীতে ৩৭টি প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে ১০টি প্রকল্প নেওয়া হয় ফুলপুর উপজেলায়, যার মধ্যে ৯টি প্রকল্প রামভদ্রপুর ইউনিয়নের নিজ আশাবট গ্রামে। প্রতিটি প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয় ৩ লাখ টাকা।

এসব প্রকল্পে সুপেয় পানির অবকাঠামোর টাইলস ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, সুপেয় পানির অবকাঠামো নির্মাণ, সীমানাপ্রাচীর, নালা নির্মাণ ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রকল্পের তালিকায় দেখা গেছে, এক নম্বরেই রয়েছে নিজ আশাবট গ্রামের হাজি শমসের আলী সাহেবের কবরস্থান উন্নয়ন। শমসের আলী স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর দাদা। ৪ নম্বর প্রকল্প নিজ আশাবট গ্রামের সামাজিক কবরস্থানের সীমানাপ্রাচীর টাইলসকরণ। তালিকার ৮, ২১, ২৪, ২৫, ২৭ ও ৩২ নম্বর প্রকল্পও একই কবরস্থানকে কেন্দ্র করে। এসব প্রকল্পে সুপেয় পানির অবকাঠামোর টাইলস ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, সুপেয় পানির অবকাঠামো নির্মাণ, সীমানাপ্রাচীর, নালা নির্মাণ ইত্যাদি উল্লেখ রয়েছে।

নিজ আশাবট গ্রামে ২৬ অক্টোবর দুপুরে গিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের বাড়ির সামনে পারিবারিক কবরস্থানে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলতে দেখা যায়। তখন পর্যন্ত কবরস্থানের সীমানাপ্রাচীর, মোটর স্থাপন, পানির ট্যাংক বসানো ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার কাজ এগিয়ে ছিল। সেখানে ‘পারিবারিক কবরস্থান’ লেখা একটি পুরোনো সাইনবোর্ডও দেখা গেছে।

জেলা পরিষদের প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে কবরস্থানটিকে ‘সামাজিক’ বলা হলেও এটি গ্রামের সবার জন্য উন্মুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। স্থানীয় সরকার সচিবের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বলেন, এটি পারিবারিক কবরস্থান। কিছুদিন আগে কবরস্থানের সীমানা চিহ্নিত করে দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। কাজটি সরকারিভাবেই হচ্ছে।

কবরস্থানের সীমানাপ্রাচীর, মোটর স্থাপন, পানির ট্যাংক বসানো ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার কাজ এগিয়েছিল। সেখানে ‘পারিবারিক কবরস্থান’ লেখা একটি পুরোনো সাইনবোর্ডও দেখা যায়।

জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেনের বিরুদ্ধে ২০২৪–২৫ অর্থবছরের কম্বল কেনায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

জেলা পরিষদ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, গত ২৮ জানুয়ারি কম্বল কেনার একটি কার্যাদেশ দেন কবির হোসেন। জেলার ১৩টি উপজেলার দুস্থ, অসহায় ও গরিব মানুষের জন্য প্রায় ৪৯ লাখ ৯৮ হাজার টাকা ব্যয়ে ১২ হাজার কম্বল সরবরাহের জন্য নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের মেসার্স হাওলাদার এন্টারপ্রাইজকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কার্যাদেশ অনুযায়ী সাত দিনের মধ্যে উপসহকারী প্রকৌশলীর কাছে কম্বল সরবরাহের কথা।

জেলা পরিষদের উপসহকারী প্রকৌশলী ও কম্বল ক্রয় কমিটির সদস্য আবদুর রউফ বলেন, ‘আমি কোনো কম্বল বুঝে পাইনি।’ কম্বলের বিল কীভাবে পরিশোধ হলো—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটি আমি জানি না।’

জেলা পরিষদের প্রধান সহকারী মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কম্বল বুঝে পাওয়ার কোনো নথি আমাদের কাছে নেই। তবে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কম্বল বিতরণ হয়েছে বলে কিছু কাগজ আমাদের দিয়েছেন।’

জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার তাহমিনা আক্তার। তাঁর স্বাক্ষর জাল করে প্রায় ১ কোটি ১৩ লাখ টাকার প্রকল্প গ্রহণের কার্যবিবরণী তৈরির অভিযোগ উঠেছে কবির হোসেনের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নজরে আসার পর কবির হোসেনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান জেলা পরিষদের প্রশাসক তাহমিনা আক্তার।

নোটিশের যথাযথ জবাব দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন কবির হোসেন। স্থানীয় সরকার সচিবের বাড়ির সামনে একই জায়গায় আটটি প্রকল্প দেওয়া এবং কম্বল কেনায় অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রকল্প সব তো আমি একা করি না, মাসিক সভায় অনুমোদন করে মন্ত্রণালয় হয়ে আসে। কোনো সমস্যা থাকলে আমরা অনেক সময় প্রকল্প পরিবর্তন করি।’

এদিকে স্থানীয় সরকার সচিবের কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলীসহ অন্য কর্মচারীদের বিভিন্ন বেআইনি কাজে বাধ্য করতে অনবরত চাপ দেন কবির হোসেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, তাঁর ‘অত্যাচার’ থেকে ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের সম্পদ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

জেলা পরিষদের ২০২৪–২৫ অর্থবছরের রাজস্ব বাজেটে ঐচ্ছিক কার্যাবলির আওতায় অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেখিয়ে অর্থ লুটপাটের অভিযোগ ইতিমধ্যে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিভাগীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা পরিষদের প্রশাসক তাহমিনা আক্তার।

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন