আওয়ামী লীগের দুজনকে ছাড়াতে ওসিকে যুবদল নেতার হুমকি
![]() |
| আটক দুজনকে ছাড়াতে এসে পুলিশের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পাড়েন ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সভাপতি নাজমুল হুদা | ছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত |
ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলায় পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার ‘আওয়ামী লীগ কর্মী’ দুই জনকে ছাড়িয়ে নেওয়ার সময় থানার ওসি হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে যুবদলের এক নেতার বিরুদ্ধে। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে ওসির উদ্দেশ্যে ওই যুবদল নেতাকে বলতে শোনা যায়, 'আপনি মানুষ চিনেন নাই। আপনার এখানে রিজিক নাই, রিজিক উঠে গেছে।'
ওই যুবদল নেতার নাম নাজমুল হুদা ওরফে মিঠু। তিনি পাশের পীরগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সভাপতি। পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তারকৃত দুজনকে ছেড়ে দিতে রাজি না হওয়ায় ওসির সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা চলার এক পর্যায়ে তিনি হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ। ঘটনার পর কেন্দ্রীয় যুবদল তাকে শোকজ করেছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার রাতে অভিযান চালিয়ে রানীশংকৈল উপজেলার বাচোর ইউনিয়নের রাজোর গ্রামের সারোয়ার নুর (৩২) ও হামিদুর রহমান (৬০), ভাউলারবস্তি গ্রামের খলিলুর রহমান (৫০) এবং ধর্মগড় শালফার্ম এলাকার জিয়াউর রহমান (৪২)কে আটক করে পুলিশ। বাচোর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ওই এলাকায় থাকেন এবং আটক সারোয়ার ও হামিদুরের বাড়িও একই এলাকায়। ওই দুজনকে গ্রেপ্তার করে গাড়িতে তোলার সময় জাহিদুল ঘটনাস্থলে এসে তাদের ছেড়ে দিতে পুলিশকে চাপ দেন। পুলিশ রাজি না হওয়ায় তিনি বিভিন্নজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। পরে পুলিশ তাদের থানায় নেওয়া হয়।
গতকাল বুধবার বেলা ১১টার দিকে জাহিদুলের নেতৃত্বে ৩০ থেকে ৩৫ জন থানায় উপস্থিত হন। পরে পীরগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সভাপতি নাজমুল হুদা থানায় এসে সারোয়ার ও হামিদুরকে আত্মীয় দাবি করে তাদের ছেড়িয়ে দিতে ওসিকে অনুরোধ করেন। তারা দাবি করেন, আটক ব্যক্তিরা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত নন। বেলা দেড়টার দিকে নাজমুল হুদা ও জাহিদুল ইসলাম মিলিয়ে তাদের ছেড়ে দিতে ওসিকে চাপ দেওয়া শুরু করেন। রাজি না হওয়ার এক পর্যায়ে ওসির সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ান তারা। এলাকার কয়েকজনও এতে যোগ দেন। ঘটনার দুটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রকাশিত ৪ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে থানা ভবনের সামনে লোকজটলা দেখা যায়। এ সময় যুবদল নেতা নাজমুল হুদাকে বলতে শোনা যায়, 'মামলা করে ফেলেছেন, বলে দেন। কোনো কিছুই বলেন না। তিনটা থেকে ফোন দিচ্ছি, আমি মানুষ না?' জবাবে ওসি বলছেন, 'আমি তো বলেছি, হবে না।' তারপর নাজমুল বলেন, 'ফালতু কথা বলবেন না। হবে না এ কথা বলেন নাই। মিথ্যা কথা বলবেন না... আপনি মানুষ চিনেন নাই। আপনার এখানে রিজিক নাই, রিজিক উঠে গেছে।' ওসি তাদের চলে যেতে বললে অন্যান্যরা কথাবার্তা বাড়ান।
আরেকটি ১ মিনিট ২০ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, নাজমুল ওসিকে বলছেন, 'পোশাকের ই দেখাইলেন, আর কি! আর চ্যালেঞ্জ করলেন আমাদের সঙ্গে।' তখন এক পুলিশ সদস্যকে বলতে শোনা যায়, 'এত কথা বলিয়েন না ভাই।' এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নাজমুল বলেন, 'কেন কথা বলব না? শোনেন আওয়ামী লীগ আমলের থেকে এখন আরও বেশি ই হচ্ছে।' তখন ওসি তাদের চলে যেতে বললে নাজমুল বলেন, 'কেন যাব? থানা আমরাও সেভ করছি, বুঝলেন? তিন-চার দিন থানায় বসে ছিলাম। না হলে থানা জ্বালায় দিত। আমরা কথা বলব না তো, কে কথা বলবে?'
জানতে চাইলে রানীশংকৈল থানার ওসি আরশেদুল হক বলেন, মঙ্গলবার রাতে আটক হয়েছেন সবাই—আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থক। তাদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইন ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয়েছে এবং আদালতে পাঠানো হয়েছে। আটককৃতদের ছাড়িয়ে নিতে স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও পীরগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সভাপতি থানায় এসে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছেন। তখন পুলিশ সদস্যদের হাড়গোড় ভাঙাসহ থানা জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে যুবদল নেতা নাজমুল হুদা বলেন, মঙ্গলবার রাতে তাঁর ব্যবসার অংশীদার ও বাবাকে পুলিশ আটক করেছে। ওসিকে ফোন করলে তাকে থানায় যেতে বলা হয়। তিনি রানীশংকৈল থানায় গিয়ে পুলিশকে জানান, তারা কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত নয়। কিন্তু ওসি কোনো উত্তর না দিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে থাকা নির্দেশ দেন। ওসির সেই আচরণের প্রতিবাদ করার কারণেই তিনি ঘটনাস্থলে যান। হুমকি দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে নাজমুল বলেন, 'পুলিশকে হুমকি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি শুধু বলেছি, ৫ আগস্ট আমরা থানা পাহারা না দিলে উত্তেজিত জনগণ থানা পুড়িয়ে দিত।'
এদিকে ওসিকে হুমকি দেওয়ার ঘটনার কারণে যুবদল নেতা নাজমুল হুদাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় যুবদল। আজ বৃহস্পতিবার যুবদলের কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তাঁকে আগামী তিন দিনের মধ্যে যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুল মোনায়েম এবং সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নূরুল ইসলামের সামনে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, 'উপজেলা যুবদলের সভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে সংগঠনের নিয়ম ভঙ্গ করেছেন। সংগঠন বিরোধী এই কর্মকাণ্ডের জন্য আপনার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা নিশ্চিত করতে আগামী তিন দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুল মোনায়েম এবং সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নূরুল ইসলামের সামনে উপস্থিত হয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে হবে।'
এই বিষয়ে জানতে যুবদল নেতা নাজমুল হুদার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি।
জেলা যুবদলের সদস্যসচিব মো. জাহিদুর রহমান বলেন, পুলিশের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডার ঘটনায় নাজমুল হুদাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তাকে আগামী তিন দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে সশরীরে ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন