[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

ইয়াবার স্রোত থামছে না, আঁতাতে সবার নাম

প্রকাশঃ
অ+ অ-

মাদক না বলুন | প্রতীকী ছবি

কক্সবাজার হয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ ইয়াবা দেশে ঢুকছে। মিয়ানমারের চক্র, স্থানীয় দালাল আর রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় কোটি কোটি টাকার মাদক চলে আসছে সীমান্ত পেরিয়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কড়া নজরদারির কথা বললেও বাস্তবে ইয়াবার স্রোত থামছে না। বরং অভিযোগ উঠেছে, মাদক পাচার আগের চেয়ে আরও বেড়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা মাদক কারবারিদের সঙ্গে যোগসাজশে আছেন। এ কারণেই কার্যকরভাবে মাদক ঠেকানো যাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেও স্বীকার করেছেন, 'মাদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে গডফাদাররা চা-কফি খাচ্ছে।' 

স্থানীয়দের ভাষ্য, কক্সবাজারের অন্তত ২১টি সীমান্তপথ দিয়ে ইয়াবা আর ক্রিস্টাল মেথ দেশে ঢুকছে। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিলে এসব মাদক ঢুকছে সীমান্ত পার হয়ে। এরপর অনায়াসে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে চলে যাচ্ছে রাজধানী পর্যন্ত।

সিন্ডিকেটে জড়িত কিছু অসাধু কর্মকর্তা মাদক কারবারিদের আড়াল দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মাঝেমধ্যে অন্য বাহিনীর হাতে কিছু চালান ধরা পড়লেও আসল চক্র অক্ষত থেকে যায়। ধরা পড়ে মূলত সাধারণ বাহক বা চালান বহনকারীরা।

২০১৯ সালে আত্মসমর্পণ করা একসময়কার শীর্ষ ইয়াবা গডফাদার বলেন, ‘কত ইয়াবা আর আইস টেকনাফ দিয়ে ঢুকছে, সেটা কারও কল্পনার বাইরে। মাঝখানে কিছুটা কমেছিল। কিন্তু এখন পাচার আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। মিয়ানমারের চক্র এখন সরাসরি শহর পর্যন্ত চালান পৌঁছে দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব ঠেকাতে পারছে না। ২০টা চালান গেলে সর্বোচ্চ একটা ধরা পড়ে। অনেক সময় সেটাও হয় সমঝোতা না হলে।’

জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (ইউএনওডিসি) জানাচ্ছে, দেশে ঢোকা মাদকের মাত্র ১০ শতাংশ ধরা পড়ে, বাকি ৯০ শতাংশ বাজারে ছড়িয়ে যায়।

মাদক ব্যবসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা লাভবান হচ্ছেন—এমন অভিযোগে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ইয়াবার চালান আটকে টাকা ভাগাভাগির অভিযোগে কক্সবাজারের সাবেক পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১০ কোটি টাকার ইয়াবা বিক্রির অভিযোগে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক ওসি জাহাঙ্গীর আলমসহ সাতজন পুলিশ সদস্যকেও প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে পাঠানো হয়। গত বছরের আগস্টে রামুতে ৭০ হাজার ইয়াবাসহ ধরা পড়েন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী উপপরিদর্শক আমজাদ হোসাইন। তিনি টেকনাফে চাকরির সময় কারবারিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে নিজেই চালান বহন করতেন। গ্রেপ্তারের পর তাঁর কাছ থেকে ভেতরের সিন্ডিকেটের তথ্য মেলে।

একটি সূত্র জানায়, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক মধ্যম সারির কর্মকর্তা কক্সবাজারে দীর্ঘদিন কর্মরত থেকে নিজেই সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে ইয়াবার চালান পৌঁছে দেওয়ার অভিযোগও আছে। বিষয়টি তদন্ত হলেও তাঁকে সরানো হয়নি।

অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া মাদক কারবারিদের এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। নানা গোষ্ঠীর যোগসাজশে পাচার আরও সহজ হয়ে গেছে।

২০১৮ সালের মে মাসে র‍্যাব দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযান চালায়। পরে পুলিশ, বিজিবি আর মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও নামে। বন্দুকযুদ্ধে বহু মানুষ নিহত হলেও কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। চাপে পড়ে ২০১৯ সালে টেকনাফে ১০২ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু তাতেও সিন্ডিকেটের কার্যক্রম থামেনি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ১৫ সংস্থার সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে। কিন্তু সাম্প্রতিক অভিযানও দেখাচ্ছে, ইয়াবার স্রোত কমেনি।

১৪ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অভিযানে উদ্ধার হয়েছে ৭ লাখ ৩০ হাজার ইয়াবা। একদিনেই নাফ নদী থেকে ধরা পড়ে ২ লাখ ৪০ হাজার ইয়াবা। কোথাও মাটির নিচে, কোথাও মাছ ধরার ট্রলার বা বসতবাড়ি থেকে চালান পাওয়া গেছে।

‘মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস ২০২৫’-এ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী স্বীকার করেন, ‘মাদক এখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ধরা পড়ে শুধু বাহকরা, গডফাদাররা আড়ালে থাকে। তারা বড় হোটেলে বসে মাদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে চা-কফি খায়।’ তিনি গডফাদারদের ধরতে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেন।

পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, ‘প্রতি মাসে কোর কমিটির বৈঠকে মাদক নিয়ে আলোচনা হয়। আমরা যেকোনো মূল্যে মাদক ঠেকাতে চাই। দেশকে মাদকমুক্ত করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ।’

সাম্প্রতিক অভিযান আর উদ্ধার হওয়া চালানের পরিমাণই দেখাচ্ছে, ইয়াবার স্রোতের সামনে প্রশাসন এখনো অসহায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘যেদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরে গডফাদারদের সঙ্গে সখ্য ভাঙবে, সেদিন থেকেই ইয়াবার প্রবাহ কমতে শুরু করবে। আগে বাহিনীর ভেতরে শুদ্ধি অভিযান দরকার।’ 

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন