[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

বিভুরঞ্জন সরকার যে প্রশ্নগুলো রেখে গেলেন

প্রকাশঃ
অ+ অ-

প্রবীণ সাংবাদিক ও কলাম লেখক বিভুরঞ্জন সরকার | ছবি: সংগৃহীত

বর্ষীয়ান কলামিস্ট ও সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পর তাঁর লাশ মুন্সিগঞ্জের মেঘনা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। মরদেহটির নিশ্চয়ই সৎকার হয়েছে বা হবে; কিন্তু মৃত্যুর আগে তিনি যে একগুচ্ছ প্রশ্ন আমাদের জন্য রেখে গেছেন, এই সমাজ ও রাষ্ট্রের মুখে ছুড়ে দেওয়া সেই প্রশ্নগুলোর সৎকার কে করবে?

সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার পাঁচ দশক ধরে দুহাত ভরে লিখে গিয়েছিলেন। তাঁর সর্বশেষ লেখাটি এমন কিছু বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেছেন, তা আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে, আশঙ্কার পথ তৈরি করছে।

বিভুরঞ্জন সরকার গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন বলে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। যেদিন তিনি নিখোঁজ হন, সেদিন (২১ আগস্ট) ভোর পাঁচটায় সিদ্ধেশ্বরী থেকে ‘খোলা চিঠি’ আকারে তাঁর সর্বশেষ লেখাটি লিখেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে। তাঁর সেই লেখা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিলেও তাঁর বিদায়ে আমাদের ‘ভঙ্গুর সাংবাদিকতা’ একখণ্ড প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করে গেছে, যা নিয়ে আলোচনা করা জরুরি বলে মনে করছি।

বিভুরঞ্জন মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছিলেন আজকের পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখে পরিচিত পাওয়া এই সাংবাদিকের শেষ জীবনে যে ধকল গেছে, তা বুঝতে হলে তাঁর খোলা চিঠিকে আমাদের পড়তেই হবে। সেই চিঠিতে তিনি এমন কিছু বিষয়ের আলোকপাত করে গেছেন, তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে আলোচনায় হয়তো আমাদের আগামীর বিভুরঞ্জন সরকারদের বাঁচাতে সাহায্য করবে।

বিভুরঞ্জন সরকারকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন; কিংবা তাঁর পেশাদারি সম্পর্কে জানেন, তাঁদের কাছে তিনি ছিলেন একজন সজ্জন ও ন্যায়নিষ্ঠ সাংবাদিক, যিনি কিনা তাঁর চোখে সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা অসংগতির বিষয়ে ক্রমাগত লিখেছেন; কিন্তু দিন শেষে, তিনি নিজেই নানা অসংগতির সঙ্গে বসবাস করে গেছেন, নিজের নীতির সঙ্গে আপসের সাহস না দেখালেও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাঁকে নানা সময় বিচলিত করে রেখেছিল, যা তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে। একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিকদের প্রাত্যহিক জীবন কী ধরনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তা তাঁর পাঁচ দশকের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় তুলে ধরেছেন বর্ষীয়ান এই কলামিস্ট।

বিভুরঞ্জন সরকার তাঁর সেই আলোচিত খোলা চিঠিতে লিখছেন, ‘আমি লিখেছি সত্যের পক্ষে, মানুষের পক্ষে, দেশের পক্ষে; কিন্তু আজ যখন নিজের জীবনকে দেখি, অনুভব করি সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়। আমার পেশা আমাকে শিখিয়েছে, সত্য প্রকাশ করা মানে সাহসের সঙ্গে ঝুঁকি নেওয়ার নাম।’

সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোকে যদি সরকার গুরুত্ব দিত, তাহলে অন্তত গণ-অভ্যুত্থানে মুক্ত গণমাধ্যমের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা কিছুটা হলে পূরণ হতো। বিভুরঞ্জন আমাদের দেখিয়ে দিলেন, তোমরা যদি ন্যায়ের পথে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে চাও, তাহলে এই পেশায় সুস্থতা নিয়ে চিন্তা করো। আমরা চাই, ভবিষ্যতে কোনো বিভুরঞ্জন সরকার এ রকম খোলা চিঠি না লেখেন।

আর এই ঝুঁকি নিয়ে আমাদের দেশের হাজারো সাংবাদিক সংবাদ প্রকাশ করে আসছেন। কেউ পারছেন, আবার কেউ ঘুণে ধরা সিস্টেমের সঙ্গে আপস করে নিয়েছেন। শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সৎ সাংবাদিকতা করা কেবল দুরূহ নয়, জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণও বটে।

গণমাধ্যমগুলো মালিকপক্ষের বুকপকেট থেকে বের হতে পারছেন না। ফলে তাঁবেদারি কিংবা তুষ্ট করার সাংবাদিকতায় বেশি চর্চিত হচ্ছে। শাসকদের বিরুদ্ধে গেলে শাসকেরা লাল চোখ দেখান পত্রিকার মালিকদের বা সম্পাদকদের। এই চর্চা কয়েক বছর ধরে চলে আসার পরিপ্রেক্ষিতে ‘নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতা’ কিংবা সীমাবদ্ধ প্রতিবেদন সংবাদমাধ্যমগুলো কাভার করতে বাধ্য হচ্ছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, যাঁরা এই ‘বনসাই জার্নালিজম’ করতে পারেন না, তাঁদের বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে।

ফলে সংবাদমাধ্যমগুলোই চাচ্ছে না আমাদের সাংবাদিকেরা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করুক। এর মূল কারণ হচ্ছে, সরকার কিংবা ক্ষমতাশালী অংশের বিরুদ্ধে গিয়ে সাংবাদিকতা করতে গেলে যে চাপ আসবে, তা সহ্য করার সক্ষমতা সব গণমাধ্যমের থাকে না। বিজ্ঞাপন হারানোর ভয় থেকে শুরু করে করপোরেট হাউসগুলোর মালিকপক্ষের ব্যবসার কথা বিবেচনা করে একধরনের আপসের সম্পাদকীয় নীতিমালা করতে হচ্ছে। ফলে পাঠকেরা অনেক সময় ডিপ জার্নালিজম দেখার সুযোগ পান না।

অভিযোগ আছে, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে সংবাদমাধ্যমগুলোকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হতো, তাতে ভয়ের সংস্কৃতি চর্চা হয়েছে; কিন্তু গণ-অভুত্থানের পর আমরা এই অভিযোগ থেকে সংবাদমাধ্যমগুলোকে দূরে রাখতে পারিনি। তাঁর প্রমাণ মেলে প্রয়াত সাংবাদিক বিভুরঞ্জনের লেখায়। তিনি বলছেন, গত বছর সরকার পরিবর্তনের পর গণমাধ্যমের অবস্থা আরও কাহিল হয়েছে। মন খুলে সমালোচনা করার কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন; কিন্তু তাঁর প্রেস বিভাগ তো মনখোলা নয়। মিডিয়ার যাঁরা নির্বাহী দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা সবাই আতঙ্কে থাকেন সব সময়। কখন না কোনো খবর বা লেখার জন্য ফোন আসে। তুলে নিতে হয় লেখা বা খবর!

সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের লাশ শনাক্ত করার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তাঁর ভাই চিররঞ্জন সরকার ও ছেলে ঋত সরকার  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন  

এমন অভিযোগ আমরা ঢাকার অনেক সাংবাদিকের মুখে শুনছি। সর্বশেষ বিভুরঞ্জন সরকার যে অভিযোগ তুলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চিত্র অঙ্কন করে গেছেন, তা সত্যিই বেদনাদায়ক। সমালোচনা সহ্য করার সক্ষমতা না থাকলে দেশে কখনোই গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরবে না, বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমকে শক্তিশালী করার চেষ্টা না থাকলে কোনো ঐকমত্য কিংবা সংস্কার বিফলে যাবে।

সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা না থাকায় এই পেশায় এসে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কয়েক দশক ধরে এমন প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করছি। অনেক তারকা সাংবাদিক এসে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাটুকু করার যখন চেষ্টা করে দিন শেষে আর্থিক দৈন্যের শিকার হন, তখন স্বভাবত এই পেশাকে তাঁরা ‘গুডবাই’ জানিয়ে তুলনামূলক বেশি বেতনের চাকরি লুফে নিচ্ছেন। ফলে সাংবাদিকতায় মেধাবীদের যে বিচরণ, তা কমতে শুরু করেছে। বিভুরঞ্জন সরকার তাঁর সেই খোলা চিঠিতে এমনই এক অভিযোগ করে গেছেন। তিনি লিখেছেন, আজকের সময়ে সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ অন্য রূপ। অনেকেই সুবিধা, স্বার্থ, সামাজিক মর্যাদা বা আর্থিক স্বার্থের জন্য সত্যকে আড়াল করে লেখেন।

আর এসব করতে গিয়ে ক্ষতির শিকার তিনি কিংবা তাঁর পরিবার। বাবার লেখালেখির প্রভাব গিয়ে পড়ে সন্তানদের শিক্ষালয়ে বা পেশায়। বিভুরঞ্জনের ক্ষেত্রে সেটি হয়েছে বলে তিনি  অভিযোগ করে গেছেন, যা আমাদের অবাক করেছে। একজন সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁর সততা। এই সততাকে আড়াল করলে সাংবাদিকের যে অবয়ব আসে বড়ই বেমানান। এই পেশার মানুষগুলোকে আমরা মুখে মুখে ‘মহান পেশা’ দাবি করে পিঠ চাপড়ালেও দিন শেষে একজন সৎ সাংবাদিকের আর্থিক সচ্ছলতা অনেকটাই বিভুরঞ্জনের মতো।

৫০ বছর সাংবাদিকতা করার পর ঢাকার বুকে যদি কোন মাথা গোঁজার নিজের জায়গা না থাকে, মাস শেষে যদি অন্যের কাছে ধার-দেনা করতে হয়, তাহলে এই পেশা আদৌ কোনো ‘হেলদি’ পেশা হতে পারে না।

এই শহরে হাজারো সাংবাদিক আছেন। পেটের দায়ে তাঁরা সীমাহীন পরিশ্রম করে টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছেন; কিন্তু একসময় এসে তাঁদের অনেকের উপলব্ধি হয়, মাস শেষে তিনি যে বেতন পাচ্ছেন এই শহরের রিকশাচালকেরা তার চেয়ে বেশি আয় করেন। নিজের স্ত্রী-সন্তানদের ঠিকমতো খাবার জোগাড় করতেই তাঁদের হিমশিম খেতে হয়। এসব যাতনা থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই ‘সুবিধাবাদী’র খাতায় নাম লেখান। সরকারকে খুশি করার জন্য সাংবাদিকতার পকেটে ঢোকে অ্যাক্টিভিজম। আর এসব করে অনেকেই আর্থিক সচ্ছলতা গড়েন, গাড়ি-বাড়ি করেন।

এই সংখ্যা কেবলই মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কপালে জুটলেও বিভুরঞ্জনদের ক্যাটাগরি অনেকটাই প্রশস্ত। চাকরি করে আর্থিক নিরাপত্তা না পাওয়া সাংবাদিকেরা ‘অনিয়ম ও নানা ধরনের তদবিরে’ জড়িয়ে পড়ে সাংবাদিকতার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ছেন। প্লট, বিদেশভ্রমণ থেকে শুরু করে নানান সুবিধাপ্রাপ্ত এসব সাংবাদিকের কাছে সততার বড়াই করে এগিয়ে চলা বিভুরঞ্জনরা পরাজিত হন।

এসব জীবন্ত অভিজ্ঞতা দেখার পর কোন ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে আর্থিক টানাপোড়েনের পেশাকে গ্রহণ করতে চাইবে? এই যে এত এত গণমাধ্যম আমাদের, কই এসব সংবাদমাধ্যম কি সাহস দিয়ে বলতে পারছে, আসুন আমরা একটি শক্তিশালী নীতিমালা করি, যেখানে থাকবে সাংবাদিকদের আর্থিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা?

হ্যাঁ, সাংবাদিকদের বেতনকাঠামোর জন্য ওয়েজ বোর্ড আছে; কিন্তু দীর্ঘদিন নবায়ন না হওয়া কিংবা সেই ওয়েজ বোর্ড অনুসরণ না করা সংবাদপত্রগুলো দিনের পর দিন প্রতারণা করে যাচ্ছে, মালিকপক্ষ বেতন নিয়ে তাইরেনাইরে করছে, তার হিসাব কয়জন কষে? পেশাদারি বজায় রেখে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করার অভিপ্রায় যে নেই, তা নয়; কিছু সংবাদমাধ্যম সেই নীতিমালা অনুসরণ করে। তবে সেটি হাতে গোনা।

আমাদের শত শত গণমাধ্যমের প্রয়োজন নেই। এক ডজন গণমাধ্যম যদি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার চর্চাটুকু করে, সাংবাদিকদের ন্যায্য বেতন দেয়, অন্যান্য পেশার মতো তাঁদের সুযোগ-সুবিধা দেয়, তাহলে আমরা এভাবে বিভুরঞ্জনদের হারাতাম না।

সাংবাদিকতায় বিভুরঞ্জনদের না রাখতে পারার দায় অবশ্যই আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোর রয়েছে। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে না পারা বিভুরঞ্জনরা এই পৃথিবীকে বিদায় জানালেও আগামীর বিভুরঞ্জনদের এই পেশায় ধরে রাখতে হলে সংবাদমাধ্যমগুলোকে সংস্কার করতেই হবে।

সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোকে যদি সরকার গুরুত্ব দিত, তাহলে অন্তত গণ-অভ্যুত্থানে মুক্ত গণমাধ্যমের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা কিছুটা হলে পূরণ হতো। বিভুরঞ্জন আমাদের দেখিয়ে দিলেন, তোমরা যদি ন্যায়ের পথে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে চাও, তাহলে এই পেশায় সুস্থতা নিয়ে চিন্তা করো। আমরা চাই, ভবিষ্যতে কোনো বিভুরঞ্জন সরকার এ রকম খোলা চিঠি না লেখেন।

● লেখক: গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। 

*মতামত লেখকের নিজস্ব 

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন