প্রতিনিধি কয়রা

জরাজীর্ণ ঘরের সামনে বৃষ্টির ফোঁটা ধরে রাখার চেষ্টায় বসানো পুরোনো মাটির হাঁড়ি। শুক্রবার সকালে কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখ সরদারপাড়া গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

শুক্রবার সকাল। খুলনার কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখ সরদারপাড়া গ্রাম। রাতভর ঝরার পর বৃষ্টি থেমেছে কিছুক্ষণ আগে। গ্রামের পিচ্ছিল পথ ধরে হেঁটে চলতে হয় পা মেপে মেপে। চারপাশ কাদা আর পানিতে একাকার। তারই ফাঁকে চোখে পড়ে এক জরাজীর্ণ ঘর। ঘরের সামনে মাটির উঁচু ঢিবিতে বসানো একটি পুরোনো মাটির হাঁড়ি। ঘরের চালের সঙ্গে বাঁধা মরিচা ধরা এক টুকরা টিন। তার মাথায় ঝুলিয়ে রাখা দড়ির সঙ্গে টিনের ভাঙা টুকরা জোড়া দেওয়া। সেখান থেকে পানি চুইয়ে পড়ছে হাঁড়ির ভেতর।

পাশে দাঁড়িয়ে বাড়ির বাসিন্দা ৭০ বছরের ছবিরন বেগম হাঁড়ি থেকে মগে করে পানি তুলে নিচে রাখা বালতিতে ঢালছেন। বাড়ির মধ্যে পা দিতেই এগিয়ে এলেন ছবিরনের পুত্রবধূ ফজিলা খাতুন। বৃষ্টির পানি সংগ্রহের এই উপায়টা তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। বললেন, ‘খাওয়ার পানির বড় কষ্ট আমাগের। বৃষ্টি হলেই এই পানি জমাই, এইটাই খাই। কিন্তু গোসল করি নদীর লোনাপানিতে। আর বৃষ্টি না থাকলে তখন নৌকা নিয়ে অনেক দূরের পুকুরে যাইতে হয় খাওয়ার পানি আনতে।’

ছবিরন বেগমদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আশপাশে একই চিত্র দেখা যায়। কোথাও ঘরের সামনে পলিথিন ঝুলিয়ে হাঁড়িপাতিল পেতে রাখা হয়েছে, কোথাও আবার চালের নিচে প্লাস্টিকের ড্রামের সাহায্যে বানানো হয়েছে অস্থায়ী রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম। জীবনযুদ্ধে রোজগারের পাশাপাশি পানি জোগাড় করাটাও এখানে বড় এক চ্যালেঞ্জ।

শেখ সরদারপাড়ার গল্প যেন পুরো কয়রা উপজেলার প্রতিচ্ছবি। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুন্দরবন সংলগ্ন মহেশ্বরীপুর, বাগালী, আমাদি, মহারাজপুর ও সদর ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামে বছরজুড়েই মিঠাপানির তীব্র অভাব। নলকূপ থাকলেও লবণাক্ত পানি ওঠে, তাই বৃষ্টির পানি আর দূরের পুকুরই ভরসা।

শেখ সরদারপাড়া গ্রামের পাশের কয়রা নদীর পানি মুখে দিয়ে চেখে দেখা যায় লবণাক্ততা কিছুটা কমেছে বর্ষার কারণে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে সেই পানি মুখের কাছেও নেওয়া যায় না। নদী থেকে কলসিতে পানি ভরে বেড়িবাঁধ বেয়ে ফিরছিলেন আসমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘নদীর এই নোনাপানিতেই ঘরের সব কাজ করি। এখন বৃষ্টির পানি খাই, বর্ষা গেলে সেইটাও পাই না। নোনাপানির কারণে গায়ের রং কালচে হয়ে গেছে। দূরের আত্মীয়রাও আর এখানে আসতে চায় না।’

গ্রামের আসাদুল ইসলাম বলেন, গত বছর গ্রামের কয়েকজন মিলে খুলনার রূপসা নদীর নৌকাবাইচে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। পুরস্কারের টাকায় এলাকায় একটি মিষ্টি পানির পুকুর খনন করা হয়েছে। এখন বৃষ্টি না হলে সেই পুকুরের পানি দিয়েই গ্রামের মানুষ কিছুটা হলেও মিঠাপানির সংকট মেটানোর চেষ্টা করে। ছোট্ট সেই জয় আজ অনেকের জীবনের বড় ভরসা হয়ে উঠেছে।

এই বাস্তবতার কথা জানিয়ে কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর সমাধান পেতে হলে প্রকৃতির দিকেই ফিরতে হবে। বর্ষাকালে পানি ধরে রাখতে বেশি করে পুকুর খনন ও সংরক্ষণ পদ্ধতি চালু করলেই একদিন এই পানির সংকট কমে আসবে।

কয়রা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, উপকূলীয় কয়রায় লবণাক্ততার কারণে অনেক স্থানে গভীর নলকূপ বসিয়েও সুপেয় পানি মিলছে না। তাই ভূ-উপরিস্থ ও বৃষ্টির পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৫৫ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছেন। তিনি জানান, সরকারিভাবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য পানির ট্যাংক দেওয়া হচ্ছে, কেউ এখনো না পেলে আবেদন করলে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে।