প্রতিনিধি ফেনী

ফেনীর ফুলগাজী মুন্সিরহাটের আলী আজম উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া দুর্গত মানুষজন। গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারি–বেসরকারি সহায়তা পাননি তাঁরা। আজ দুপুরে তোলা  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

বৃষ্টি কমায় ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কমেছে নদ-নদীর পানি। জেলার অনেক জায়গা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে বেশ কিছু এলাকা। পরিস্থিতির উন্নতি হলেও আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় দুর্গত মানুষজনের ভিড় বেড়েছে। এ কারণে সেখানে শুকনা খাবার ও সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

জেলা আবহাওয়া অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, গতকাল বুধবার দুপুর ১২টা থেকে আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত জেলায় ৫০ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা গত দুই দিনের চেয়ে কম। তবে ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়ক ডুবে থাকায় তৃতীয় দিনের মতো ছোট-বড় সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ কারণে ফেনী জেলা সদরের সঙ্গে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার সড়কপথ দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

জানতে চাইলে ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (উচ্চ পর্যবেক্ষক) মো. মজিবুর রহমান বলেন, গত দুই দিনের তুলনায় আজ বৃষ্টি কম হয়েছে। এ কারণে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

এদিকে আজ দুপুর ১২টায় মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এই নদীর পানির বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার। তবে আজ তা ১০ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটারে দাঁড়িয়েছে। ভারী বর্ষণ না থাকা ও উজান থেকে ঢলের পানি কম আসায় নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নেমেছে বলে জানিয়েছেন ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গত তিন দিনে সীমান্তবর্তী মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ফুলগাজী ও পরশুরাম অংশের ২০টি স্থান ভেঙে দুই উপজেলার ২৭ গ্রাম প্লাবিত হয়। এর মধ্যে পরশুরাম উপজেলায় বেড়িবাঁধের ১২টি অংশ ও ফুলগাজী উপজেলার ৮টি অংশ ধসে পড়ে। গত ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টি না হওয়ায় মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানিও কমতে শুরু করেছে। তবে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলা থেকে পানি কিছুটা কমলেও নতুন করে ছাগলনাইয়া ও সদর উপজেলার বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। দুর্ঘটনা এড়াতে গতকাল রাত পর্যন্ত পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার ৩১ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ছিলেন। তবে আজ সকাল থেকে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হচ্ছে।

ফেনীর ফুলগাজীর উত্তর শ্রীপুর গ্রামের বন্যা দুর্গতদের উদ্ধারে নেমেছে সেনাবাহিনীর একাধিক দল । আজ সকালে তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

জেলা প্রশাসন দুই উপজেলার ২৭টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার তথ্য দিলেও চার উপজেলার অর্ধশতাধিক গ্রামে পানি উঠেছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। জনপ্রতিনিধি ও এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজ দুপুর পর্যন্ত ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম, ফেনী সদর ও ছাগলনাইয়ার অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন এখনো।

ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইসমাইল হোসেন জানান, গতকাল রাতে ফুলগাজী, পরশুরাম ও ফেনী সদর উপজেলার আংশিক অংশ বন্যাকবলিত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে প্রায় ১৯ হাজার ৫৬০ জন মানুষ দুর্যোগকবলিত হয়েছেন। আর গতকাল রাত পর্যন্ত তিন উপজেলায় ৪৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১ হাজার ৫৯৩টি পরিবারের ৫ হাজার ৭৭৬ জন অবস্থান করছিলেন। দুর্গত এলাকার মানুষজন এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে আসছে। এ কারণে বাড়ছে ভিড়।

আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্যসংকট

আজ সকালে সরেজমিন দেখা যায়, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় শুকনা খাবার ও সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বেশির ভাগ আশ্রয়কেন্দ্রের পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থাও নেই।

ফুলগাজীর আলী আজম উচ্চবিদ্যালয় এবং পাশের মাদ্রাসার ভবনে প্রায় শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করা ব্যক্তিরা এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সহযোগিতা পাননি। অনেকেই গতকাল রাত থেকে এখন পর্যন্ত কোনো খাবার পাননি। কেউ কেউ স্কুল ভবনেই চুলা বানিয়ে রান্না করেছেন।

জানতে চাইলে উত্তর শ্রীপুর গ্রামের বাসিন্দার পঞ্চাশোর্ধ্ব রোকসানা আক্তার বলেন, ‘বাড়িতে গলা পর্যন্ত পানি। পরিবারের ১৩ জন পরনের কাপড় নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোতলা ভবনের একটি কক্ষে গাদাগাদি করে প্রায় ৪০ জন মিলে থাকছি। বৃদ্ধা ও শিশুরা বেশি কষ্ট পাচ্ছেন।’

একই গ্রামের গৃহবধূ স্বপ্ন আক্তার বলেন, ‘ছোট দুটি শিশু নিয়ে পাঁচজন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছি। বুধবার দুপুরে কেন্দ্রে অবস্থান নিলেও আজ দুপুর পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি কোনোরকমে সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি।’

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামে বলেন, ‘সব জায়গায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। কোথাও যদি ত্রাণ না পৌঁছায়, তবে সেখানেও পাঠানো হবে।’

আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার না পাওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহরিয়া ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি বক্তব্য দেননি। পরে কথা বলবেন বলে তিনি প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।

উদ্ধারে নেমেছে সেনাবাহিনী ও বিজিবি

আজ দুপুর থেকে ফুলগাজীর পানিবন্দী বিভিন্ন গ্রামে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে সেনাবাহিনীর কয়েকটি দল। সেনাবাহিনীর ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের দুরন্ত ১৫ সাপোর্ট ব্যাটালিয়নের ১৩৯ সদস্যের একটি কোম্পানি উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার কাজে নেমেছে। তারা সহস্রাধিক প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণের জন্য ফুলগাজীতে এনেছে।

সেনাবাহিনীর কোম্পানির দায়িত্বে থাকা মেজর মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান বলেন, ‘আজ দুপুর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার কাজ শুরু করা হয়েছে। সেনাবাহিনী নিজস্ব ১০টি স্পিডবোটের মাধ্যমে দুর্গম এলাকায় পানিবন্দী মানুষজনকে উদ্ধারে কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া কয়েকটি ছোট ডিঙিনৌকা দিয়ে উদ্ধারকাজ চালানো হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রয়োজন হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেনাবাহিনী পানিবন্দী মানুষের পাশে থাকবে।’

এদিকে পানিবন্দী মানুষজনকে গতকাল রাত থেকে রান্না করা খাবার বিতরণ করছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। আজ সকালেও ফুলগাজীর বিভিন্ন স্থানে খাবার বিতরণ করেছেন বিজিবির সদস্যরা।