প্রতিনিধি রংপুর

রংপুরের বদরগঞ্জের সফল খামারি মশিউর রহমান নিজের পুকুর থেকে মাছ ধরছেন। শুক্রবার দুপুরে তোলা  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

সংসারের টানাপোড়েন রোধে ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে চেয়েছিলেন কৃষক বাবা; কিন্তু ছেলে চেয়েছিলেন দেশে থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু করার। ১৫ বছর আগে বাবার কাছ থেকে ৮১ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ির পাশে মুরগির খামার শুরু করেন তিনি। লাভের টাকায় জমি কিনে পাঁচটি পুকুর কেটে মাছ চাষ করেন। এরপর একে একে হাঁস, ছাগল ও গরুর খামার গড়েছেন। এখন তিন কোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি। খামারগুলো থেকে প্রতিবছর আয় হচ্ছে ৩০ লাখ টাকা।

সফল এই খামারির নাম মশিউর রহমান। তাঁর বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের মৌলভীপাড়া গ্রামে। বাবার নাম রফিকুল ইসলাম। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড়। রংপুরের কারমাইকেল কলেজের ইতিহাস বিভাগ থেকে ২০১৭ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তাঁর খামারে কাজ করছেন ২১ জন। তাঁর অনুপ্রেরণায় এলাকার অনেকে খামার গড়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। সম্মাননা হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ মৎস্যচাষির পুরস্কারও পেয়েছেন।

মশিউর রহমান বলেন, ‘একসময় সমাজ ও বাড়িতে অবহেলিত ছিলাম। চাকরি করলে নিজে হয়তো ভালো থাকতে পারতাম। কিন্তু ২১টি পরিবারকে ভালো রাখতে পারতাম না। আজ নিজেরা যেমন ভালো আছি, তেমনি ওই পরিবারগুলোও ভালোভাবে চলছে। খামার গড়ার এটাই বড় সার্থকতা।’

খামারি হওয়ার গল্প তুলে ধরে মশিউর জানান, কৃষক বাবার কিছু আবাদি জমি ছিল। সংসারে টানাপোড়েন লেগেই থাকত। বাবা চাইতেন বড় ছেলে হিসেবে বিদেশে পাঠিয়ে সংসারের অভাব ঘোচাতে; কিন্তু তিনি বিদেশে যেতে রাজি হননি। বাড়িতে বসে কিছু করার কথা ভাবেন। একদিন কলেজে যাওয়ার পথে মুরগির খামার দেখে খামার গড়ার কথা মাথায় আসে। কিন্তু টাকা কোথায় পাবেন। বাবার কাছে চাইলে তিনি দিতে রাজি হননি। পরে এক শিক্ষকের মাধ্যমে বাবাকে রাজি করান।

নিজের মুরগির খামারে কাজ করছেন মশিউর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সুমি খাতুন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

গরু বিক্রি করে মশিউরকে ৮১ হাজার টাকা দেন বাবা রফিকুল ইসলাম। এই টাকায় খামার করা সম্ভব না হওয়ায় আরও দুই বন্ধুকে সঙ্গে নেন। ২০০৯ সালে তিন বন্ধু মিলে দুই হাজার বাচ্চা দিয়ে খামার শুরু করেন। দুই দফায় খরচ বাদে লাভ হয় ৯১ হাজার টাকা। এক বছর পর চার হাজার মুরগির বাচ্চা ওঠান। কিন্তু বিক্রির আগে খামারে মড়ক দেখা দেয়। লোকসান হয় প্রায় চার লাখ টাকা। হতাশ দুই বন্ধু খামার থেকে নিজেদের গুঁটিয়ে নেন। তবে মশিউর হাল ছাড়েননি। কলেজের পাশাপাশি একাই খামার চালাতে থাকেন। বিশ্বস্ত লোকের অভাবে পরিধি বাড়াতে পারছিলেন না। ২০১৪ সালে কলেজছাত্রী সুমি খাতুনকে বিয়ে করে স্বামী-স্ত্রী মিলে খামারে লেগে পড়েন।

মশিউর রহমান বলেন, বিয়ের পর বাবার কাছ থেকে ৫০ শতক জমি নিয়ে পুকুর কেটে মাছ চাষ ও হাঁস পালন শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি গরু ও ছাগলের খামার গড়ে তোলেন। খামারের আয়ে এলাকার বিভিন্ন স্থানে সড়কের পাশে ৩ একর ৩৬ শতক জমি কিনেছেন। সাড়ে তিন একরে পাঁচটি পুকুর করেছেন। খামারগুলোতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। সব মিলিয়ে ১৬ বছরে খামারের লাভে বর্তমানে তাঁর সহায়সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকা।

মশিউর পাঁচটি পুকুরে পাঙাশ মাছ ছেড়েছেন ৭০ হাজার। একেকটির ওজন হয়েছে ৮০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি। খামারে ব্রয়লার মুরগি আছে ১০ হাজার, হাঁস ১ হাজার ৫০০টি, ছাগল ৩৬টি এবং উন্নত জাতের গাভিসহ গরু আছে ২১টি।

মশিউর জানান, ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মুরগির খামারিদের স্বর্ণযুগ ছিল। ২০১১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রতিবছর শুধু ৭৫ হাজার মুরগি পালন করে তিনি বছরে লাভ করেছেন অন্তত ৩০ লাখ টাকা। ২০২১ সাল থেকে লাভ কমতে থাকে। খাবারের মূল্যবৃদ্ধি ও সিন্ডিকেট ব্যবসা এর জন্য দায়ী।

মশিউরের অনুপ্রেরণায় এলাকার শিক্ষিত বেকার তরুণ-যুবকেরা শতাধিক মুরগি, হাঁস ও ছাগলের খামার গড়ে লাভবান হয়েছেন। তবে লোকসানের কারণে গত বছর থেকে অনেকে মুরগির খামার বন্ধ রেখেছেন।

জামালপুর গ্রামের ফরমান আলী বলেন, ‘মশিউর ভাইয়ের কাছে পরামর্শ নিয়ে ২০১৭ সাল থেকে ব্রয়লার জাতের মুরগি ও গাভি পালন শুরু করে ২০২১ সাল পর্যন্ত ভালোই লাভ করেছি। খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভ না হওয়ায় গত বছর থেকে মুরগি পালন বন্ধ রেখেছি।’

মশিউর রহমানের খামারের হাঁস  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

আমরুলবাড়ি পলিপাড়া গ্রামের রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘২০১৬ সালে লেখাপড়া শেষ করে চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগছিলাম। মশিউর ভাইয়ের খামার দেখে চোখ খুলে যায়। তিনি আমাকে মুরগি, হাঁস ও গরুর খামার গড়ার পরামর্শ দেন। খামারের আয়ে চার বিঘা আবাদি জমি ও মোটরসাইকেল কিনেছি। পাকা বাড়ি করেছি। বর্তমানে খামারে গরু আছে ১৯টি। সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটছে।’

মশিউরের স্ত্রী সুমি খাতুন বলেন, ‘চাকরি করলে দুজনে মাসে যে বেতন পেতাম, তাঁর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা খামার থেকে আয় হয় আমাদের। ব্যবসায় লাভ–ক্ষতি দুটিই আছে। সফল হতে হতাশ না হয়ে লেগে থাকতে হয়। দরকার মনোযোগ ও ধৈর্য।’

উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা উম্মে হাবিবা বলেন, মশিউর ২০২৪ সালে উপজেলার শ্রেষ্ঠ মৎস্যচাষির পুরস্কার পেয়েছেন।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা স্বপন চন্দ্র রায় বলেন, উচ্চশিক্ষিত মশিউর এলাকার সেরা খামারি। খামার করে তিনি নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করেছেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় এলাকায় আরও শতাধিক খামার গড়ে উঠেছে।