প্রতিনিধি খুলনা

বহু বছর ধরে খুলনার নয়াবাটিতে প্রতি শুক্রবার বসে পোষা পশুপাখির হাট  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

খাঁচা থেকে ধীরে ধীরে কবুতরটা তুলে নিলেন এক ক্রেতা। পালকের নিচে-ওপরে, গলা, পা—সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে চোখ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অরিজিনাল অ্যারাবিয়ান ককা তো?’

বিক্রেতা হেসে জবাব দিলেন, ‘ভাই, বাড়িতে মাস্টার পেয়ার আছে। এইটা খাঁটি ককা জাত। কক কক করে ডাকে। ফোন নম্বর রাখেন, ঠিকঠাক না হলে ফেরত দিতে পারবেন।’

মোবাইলে ছবি মিলিয়ে আবার ভালো করে দেখে নিলেন কবুতরটা। এরপর শুরু হলো দামাদামি। বিক্রেতা বললেন, জোড়া এক হাজার টাকার নিচে হবে না। কিন্তু ক্রেতা অনড়—‘আট শ টাকার বেশি দেব না ভাই।’

শুক্রবার সকাল থেকেই এমন দর-কষাকষিতে জমে ওঠে খুলনার নয়াবাটির কবুতরের হাট। খাঁচায় খাঁচায় কবুতর, আর চারপাশে উৎসুক চোখ, দরদাম আর হালকা উত্তেজনা। শুধু কেনাবেচা নয়, এখানে চলে জাত বিচারে অভিজ্ঞতার লড়াই। মোবাইল, মুখের কথা আর চোখের ত্রিমুখী যাচাই শেষে হয় ‘ডিল’। কেউ নতুন কবুতর নিয়ে ফিরে যান, কেউ অপেক্ষায় থাকেন পরের শুক্রবারের।

ক্রেতা-বিক্রেতার দাবি, ঢাকার মিরপুরের পর এটিই দেশের সবচেয়ে বড় পাখির হাট। শুধু খুলনা নয়; যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, এমনকি আরও দূরের জেলা থেকেও শৌখিন পালনকারী ও ব্যবসায়ীরা আসেন এখানে।

তবে শুধু কবুতরেই সীমাবদ্ধ নয় এই হাট। এখন এখানে পাওয়া যায় শখের পাখি, বিড়াল, কুকুর, খরগোশ, হাঁস-মুরগি, এমনকি অ্যাকুরিয়ামের মাছও। যেন এক প্রাণী উৎসব। পাশাপাশি রয়েছে খাদ্য, খাঁচা ও আনুষঙ্গিক জিনিসের দোকানও।

প্রতি শুক্রবার ভোরে শুরু হয়ে বেলা ১টা পর্যন্ত চলে এই হাট। সময় যত গড়ায়, তত জমে ওঠে কেনাবেচা। নয়াবাটির মোড় থেকে শুরু হয়ে বাংলার মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত এই হাট ছড়িয়ে আছে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। আশপাশের গলিতেও পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা।

সরেজমিনে দেখা গেল, রাস্তার দুই পাশে সারি সারি খাঁচা। খাঁচায় খাঁচায় রঙিন কবুতর, শালিক, গাঙশালিক, কোয়েল, বাজরিগার, ককাটেলসহ নানা পাখি। সামনে ভিড় করা নানা বয়সী মানুষ। কারও উদ্দেশ্য কেনা, কারও শুধুই দেখা।

এই হাটে কবুতর, বিদেশি পাখি, বিদেশি বিড়াল-কুকুরসহ সব ধরনের পোষা পশুপাখি বেচাকেনা হতে দেখা যায়  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

এই হাটে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে কবুতর। কেউ জাত চেনার চেষ্টা করছেন মোবাইলে ছবি দেখে, কেউ অভিজ্ঞ চোখে। পালকের গঠন, চোখের রং, বয়স, ডিম দেওয়ার ধরন—সব খুঁটিয়ে দেখছেন ক্রেতারা।

কবুতরের জাতেও রয়েছে বৈচিত্র্য। দেশি কবুতর ছাড়াও দেখা যায় লক্ষ্মা, কিং সিরাজি, হোমার, শার্টিন, রেসার, রামপুরী, টেডি, লালগলা, জ্যাকোবিনসহ নানা জাত। একেকটির রং, গড়ন, স্বভাব আলাদা। দামের ব্যবধানও বেশ—কিছু জোড়া মেলে কয়েক শ টাকায়, আবার কোনো কোনো জাতের জোড়া বিক্রি হয় ২০-৩০ হাজার টাকায়। হাটে ছোট ছোট শিশু এবং নারী ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো।

১৩ বছর ধরে খুলনায় থাকা মো. সাহেদ খান পিপলস জুট মিলে চাকরি করেন, পাশাপাশি ৯ বছর ধরে এই হাটে পাখি বিক্রি করেন। তাঁর সঙ্গে দেখা গেল শালিক, গাঙশালিক, টিয়া ও খরগোশ। তিনি বলেন, ‘জমজমাট হাট এটা। ঢাকার মিরপুরের পরে এটিই সবচেয়ে বড়। হাটে এখন শুধু কবুতর নয়, সাইকেল থেকে জামাকাপড়—সব পাওয়া যায়।’

খালিশপুরের হাবিবুর রহমান এসেছেন অ্যাকুরিয়ামের লাইট কিনতে। তাঁর মতে, এখানে দাম সহনীয়। বলেন, প্রাণীপ্রেমীদের মিলনমেলা এটা। অনেকে পরিবারসহ আসেন।

হাটে আসা আবদুল্লাহ আল মুহিত বলেন, ‘আমি আজ কবুতর কিনতে এসেছি। তবে বেশির ভাগ সময় শুধু দেখতে আসি। মাঝেমধ্যে বাচ্চাকেও নিয়ে আসি, যাতে সে প্রাণীদের কাছাকাছি থাকতে পারে এবং চিনতে শেখে।’

আদরের পোষা প্রাণী নিয়ে হাটে এসেছেন অনেকে  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

খুলনার খালিশপুর হাউজিং বাজারে একটি পাখির দোকান চালান মো. নূর ইসলাম। এদিন হাটে এনেছেন ১০০ জোড়ার বেশি কবুতর। তিনি বলেন, ‘হাটের বয়স যত, আমরাও তত দিন ধরে আছি। কোনো হাটে ৫ জোড়া বিক্রি হয়, আবার কোনো হাটে ১০০ জোড়াও যায়।’

হাটের বয়স জানা গেল বিক্রেতা অনুপ রায়ের কাছে। তিনি জানান, হাটের বয়স প্রায় ২০ বছর। একসময় বসত চিত্রালী হলের সামনে, পরে সুপার মার্কেট এলাকায়, এখন বসে নয়াবাটি মোড়ে। এই হাটের নেই কোনো স্থায়ী কমিটি, খাজনা বা চাঁদাও নেওয়া হয় না। তাই বিক্রেতারা খানিকটা স্বস্তিতেই আসেন।

হাটে বিড়াল নিয়েও মানুষের আগ্রহ কম নয়। নিউমার্কেট এলাকার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. আবদুল্লাহ আল মুনতাকিম নীরব অনলাইনে বিড়াল বিক্রি করে। সঙ্গে এনেছে সাদা পার্সিয়ান জাতের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে বিড়াল—দাম যথাক্রমে সাত হাজার ও সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। নীরব বলে, ‘আজ মাছ আর কবুতরের দিকে বেশি ভিড়, বিড়ালের প্রতি আগ্রহ একটু কম।’

গলায় শিকল লাগানো একটি কুকুর ঘিরেও দেখা গেল উৎসুক মানুষের ভিড়। কেউ জাতের নাম জানছেন, কেউ দাম শুনছেন। কুকুরটি এনেছেন রাইসুল ইসলাম নাঈম। নদার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষে খুলেছেন কুকুর ও বিড়ালের খামার। এনেছেন মাত্র দুই মাস বয়সী একটি ল্যাবরেডর—দাম ২০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘এই হাটেই আমার জার্মান শেপার্ড কুকুর বিক্রি হয়েছে। এটা একটা জনপ্রিয় হাট।’

বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি, তাদের ঘিরে উৎসুক মানুষের ভিড়, দরদাম আর আড্ডা—সব মিলিয়ে নয়াবাটির হাট এখন খুলনার প্রাণবন্ত এক সাপ্তাহিক উৎসব। এটি শুধু কেনাবেচার জায়গা নয়, প্রাণীপ্রেমীদের নির্ভরযোগ্য এক মিলনমেলাও বটে।