নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। অথচ সমাজের কারও সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই সরকার এ বিষয়ে এগিয়েছে। রাখাইনে মানবিক করিডর স্থাপনের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে স্বচ্ছতা নেই। সরকারের এমন তৎপরতা বন্ধ করা উচিত। মিয়ানমারকে কোনো করিডর, চ্যানেল দেওয়ার সুযোগ নেই।
‘বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা: প্রেক্ষিত মানবিক করিডর’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব বিষয় উঠে এসেছে। শনিবার বিকেলে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এই বৈঠকের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যানালিসিস।
এই গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে ফ্রন্টলাইনের (সম্মুখযুদ্ধে) দিকে নিয়ে যাবেন না। আমাদের অস্তিত্বের ব্যাপার এখানে। আমাদের নিরাপত্তার ব্যাপার এখানে। দেশের স্থিতিশীলতার ব্যাপার। আপনি (সরকারপ্রধান) এত বড় ঝুঁকির দিকে নিয়ে গিয়ে কী অ্যাচিভ (অর্জন) করার চেষ্টা করছেন?’
অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নির্বাচনী সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাওয়া উল্লেখ করে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সেই জায়গায় না গিয়ে আর সবকিছু করা হচ্ছে।
সরকার বলেছে করিডর দিলে আরাকান আর্মির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে উল্লেখ করে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রশ্ন রাখেন, করিডর দিয়ে রোহিঙ্গাদের কেন ফেরত দিতে হবে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সময় রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত গিয়েছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
‘সরকারের স্বচ্ছতা নেই’
এই গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যানালিসিসের নির্বাহী পরিচালক কর্নেল (অব.) মো. জগলুল আহসান। তিনি অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধও উপস্থাপন করেন। করিডরের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা জড়িত উল্লেখ করে জগলুল আহসান বলেন, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে সরকারের নেওয়া ঠিক হবে না। বর্তমানে যেহেতু সংসদ নেই, তাই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে খোলামেলাভাবে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
রাখাইনে মানবিক করিডর স্থাপনের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে স্বচ্ছতা নেই বলেও প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়। তাতে বলা হয়, মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে জটিল সংঘাতে বাংলাদেশের জড়িয়ে পড়া উচিত হবে না। এ ঝুঁকি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয়।
‘এই তৎপরতা বন্ধ করুন’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যত দিন ক্ষমতায় আছেন, মানবিক করিডরের বিষয়ে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) কিছু বলবেন না বলে মনে করেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। এই গোলটেবিল বৈঠকে মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে তিনি বলেন, করিডর দেওয়া হলে তা বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, রাষ্ট্র যখন জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে, তখন জনগণের খুব সতর্ক হওয়া দরকার। কারণ, দেশের বিপদ হতে পারে। আগামী ডিসেম্বরে ভোট অনুষ্ঠানের কথাও বলেন তিনি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শাহিদুল হক বলেন, নিরাপত্তা নিয়ে সবাই কথা বলছে। বিষয়টি দেশের জন্য ভালো।
মানবিক
করিডরের বিষয়ে সমাজের কারও সঙ্গে সরকার কোনো আলোচনা করেনি উল্লেখ করে
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা সরকারকে
বলতে চাই, আপনারা যথেষ্ট করেছেন। মেহেরবানি করে যতখানি এগিয়েছেন, এই
তৎপরতা বন্ধ করুন।’
সাইফুল হক বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানবিক করিডর শেষ
পর্যন্ত সামরিক করিডরে পর্যবসিত হয়েছে। দেশ নিশ্চয় খাল কেটে কুমির আনবে না।
এ বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার।
‘দেশকে পরাশক্তির হাত থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে’
রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন অবস্থায় উল্লেখ করে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. কামরুজ্জামান মনে করেন, তাঁরা বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, লাওসসহ বিভিন্ন দেশে আছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে হবে উল্লেখ করে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, যদি এই মানবিক সহায়তা (মানবিক করিডর) পাঠানোর অসিলায় রোহিঙ্গাদের সেখানে পাঠানো যায়, সেটি বিরাট সার্থকতা।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এক থেকে দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে বলে উল্লেখ করেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক। তিনি বলেন, ‘নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঢল এই সরকার থামাতে পারে নাই। সে ক্ষেত্রে মানবিক করিডর দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ রয়েছে। এ রকম একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে এই সরকারের জড়ানো উচিত হয়নি।’
বাংলাদেশ কি ততটা মানবিক হতে পারে, যতটা তার সক্ষমতা নেই—এমন প্রশ্ন রাখেন জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব হুমায়রা নূর। গোলটেবিল বৈঠকে তিনি বলেন, দেশকে যেখানে পরাশক্তির হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেখানে এমন মানবিক করিডর দেওয়ার কারণ কী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের সঞ্চালনায় বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির স্বনির্ভরবিষয়ক সহসম্পাদক নিলোফার চৌধুরী, বাসদ নেতা রাজেকুজ্জামান রতন, ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এম এ আজিজ প্রমুখ।