প্রতিনিধি যশোর

কৃষক দল নেতাকে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুড়িয়ে দেওয়া বাড়ি দেখতে এসেছেন আশপাশের গ্রামের লোকজন। আজ শুক্রবার সকালে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

গুলি করে ও কুপিয়ে কৃষক দল নেতা তরিকুল ইসলাম হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রাম। পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িগুলোতে নারী সদস্য থাকলেও তাঁরা আতঙ্কিত। নতুন করে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের একটি বাড়িতে কৃষক দল নেতা তরিকুল ইসলামকে (৫০) কুপিয়ে এবং গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটে। ঘেরের ইজারা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ পরিবারের। তরিকুল ইসলাম উপজেলার ধোপাদী গ্রামের ইব্রাহিম সরদারের ছেলে। তিনি উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি ছিলেন।

এ ঘটনার পর রাতে একদল লোক ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের অন্তত ২০টি হিন্দু বাড়িতে লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ ছাড়া উপজেলার সুন্দলী বাজারে দুটি দোকানে অগ্নিসংযোগ এবং চারটি দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন।

স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি জানান, স্থানীয় বিল কাছুরাবাদের বেশির ভাগ জমি ডহর মশিয়াহাটী গ্রামবাসীর। সেখানে একটি ঘেরের জমির ইজারার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর মালিক ঘের ছেড়ে দিয়েছেন। এই ঘেরের জমি ইজারা নিয়ে তরিকুল ইসলাম মাছ চাষ করতে চেয়েছিলেন। অন্য আরেক ব্যক্তি ওই ঘেরের জমি ইজারা নিতে চাইলে দুজনের মধ্যে বিরোধ হয়। বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সেই ব্যক্তির লোকজন তরিকুল ইসলামকে ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁকে প্রথমে কুপিয়ে এবং পরে গুলি করে হত্যা করা হয়।

তরিকুল ইসলাম | ছবি: সংগৃহীত

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে খবর পেয়ে পুলিশ ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের পিল্টু বিশ্বাসের ঘর থেকে তরিকুল ইসলামকে উদ্ধার করে। তাঁর শরীরে তিনটি গুলির চিহ্ন এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের অনেকগুলো চিহ্ন ছিল। এরপর তাঁকে অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মো. মহিউদ্দীন বলেন, তাঁকে যখন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয় তাঁর পুরো শরীর রক্তে ভেজা ছিল। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনার অনেক আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর শরীরের ঘাড়, কাঁধ এবং মাথার বিভিন্ন স্থানে অনেকগুলো ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে দুই হাতের কবজি প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। তাঁর শরীরে গুলির চিহ্ন থাকতে পারে; কিন্তু শরীর রক্তে ভেজা থাকায় সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না।

আজ শুক্রবার সকালে ডহর মশিয়াহাটী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িগুলো পুড়ে কঙ্কাল হয়ে আছে। ঘরের টিনগুলো পুড়ে দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে। কয়েকটি ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, পুড়ে কয়লা হয়ে আছে আসবাব, জামাকাপড়, লেপ-তোশক-বিছানা, টেলিভিশন, ফ্রিজ। ঘরের ভেতর পড়ে আছে আগুনে পোড়া জিনিসপত্র। কোনো কোনো বাড়ির ঘরের মধ্যে ভাঙচুর করা খাট, চেয়ার, টেবিল, আলনা, আলমারি বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। পোড়া বাড়িগুলোর সামনে পড়ে আছে অনন্ত পাঁচটি পুড়িয়ে দেওয়া মোটরসাইকেল এবং একটি ইঞ্জিনচালিত ভ্যান। আগুনের শিখায় কয়েকটি বাড়ির পাশের গাছ পুড়ে গেছে।

অগ্নিসংযোগ করা বাড়িগুলোর আসবাবপত্র পুড়ে গেছে। আজ শুক্রবার সকালে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

এ সময় বাড়িগুলোতে কোনো পুরুষ সদস্যকে পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর থেকে তাঁরা অন্যত্র চলে গেছেন। কয়েকটি বাড়িতে কয়েকজন নারীকে পাওয়া গেল। তাঁদের চোখেমুখে আতঙ্ক।

নারীরা জানান, বৃহস্পতিবার রাতে গ্রামের সুজিত বিশ্বাসের বাড়িতে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে প্রায় ৬০০ লোক আমন্ত্রিত ছিলেন। সেখানে বিকেল থেকে দুটি মাইকে ধর্মীয় গান বাজানো হচ্ছিল। কিছু লোক অনুষ্ঠানে চলে এসেছিলেন। সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে তাঁরা জানতে পারেন পাশের একটি বাড়িতে একজন খুন হয়েছেন।

গ্রামের নারীরা জানান, আমন্ত্রিত কিছু লোক চলে আসায় অনুষ্ঠান চলতে থাকে। রাত আটটার দিকে প্রথমে চার-পাঁচজন এরপর দেড় শতাধিক লোক বাড়িগুলোতে হামলা চালায়। এ সময় লোকজন যে যার মতো করে পালিয়ে যান। হামলাকারীরা বাড়ি বাড়ি ঢুকে ঘরে থাকা জিনিস লুট করে। দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে যায়। এরপর তারা ঘরের আসবাব এক জায়গায় করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের তিনটি হারমোনিয়াম এবং তিনটি ঢোল ভাঙচুর করা হয়। অনুষ্ঠানের সব খাবারও নষ্ট করে দেয়। তারা অনন্ত ১০ জন নারী-পুরুষকে পিটিয়ে আহত করে। যাওয়ার সময় তারা সুজিত বিশ্বাসের ছেলে সাগর বিশ্বাসকে (২৫) ধরে নিয়ে যায়। এরপর তারা সুন্দলী বাজারে দুটি দোকানে অগ্নিসংযোগ এবং চারটি দোকান ভাঙচুর করে। তার আগে দোকানগুলোতে লুট করা হয়। রাত ১০টার দিকে সেনাবাহিনী ও পুলিশ পাহারায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে বাড়িগুলোর আগুন নেভান।

গৃহবধূ পান্না বিশ্বাস বলেন, ‘ঘরে টিভি, ফ্রিজ, সোনাদানা, পাসপোর্ট, ওষুধের প্রেসক্রিপশন, নগদ দেড় লাখ টাকা ছিল। এখন আর কিচ্ছু নেই। শুধু বাড়ির ছয়টি মানুষ বেঁচে আছি।’ গৃহবধূ স্মৃতি বিশ্বাস বলেন, ‘প্রথমে লোকজন এসে ঘরে ঢুকে সোনাদানা, টাকাপয়সা লুট করেছে। তারা আমাকে বেদম মারধর করেছে। এরপর আমাকে লাথি দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছে।’

কৃষক দল নেতাকে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুড়িয়ে দেওয়া একটি বাড়ি। আজ শুক্রবার সকালে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

এদিকে ডহর মশিয়াহাটী গ্রামে হামলার শিকার বাড়িগুলো পরিদর্শন করেছেন বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ। তাঁর সঙ্গে আরও ছিলেন বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জিল্লুর রহমান, ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা গাজী আব্দুল হামিদ প্রমুখ।

তরিকুল হত্যার বিচার দাবি করে ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘আমরা তরিকুল হত্যার বিচার চাই। দোষীদের আটক ও বিচার চাই। কিন্তু তরিকুল হত্যাকে কেন্দ্র করে একটি বিশেষ মহল শুধু লুটপাটের উদ্দেশ্যে ডহর মশিয়াহাটি (বাড়েদা) গ্রামে ১৯–২০ বাড়িতে লুটতরাজ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করেছে। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা প্রতিবাদ জানাচ্ছি ও বিচারের দাবি জানাচ্ছি। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি।’

অভয়নগর থানার ওসি আবদুল আলিম বলেন, মাছের ঘের সংক্রান্ত দ্বন্দ্বে তরিকুল ইসলামকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে এখনো মামলা হয়নি।

ওসি বলেন, ডহর মশিয়াহাটীর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে সাগর বিশ্বাস আত্মগোপনে ছিলেন। আজ দুপুরে তাঁকে ডহর মশিয়াহাটী গ্রাম থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি পুলিশ হেফাজতে আছেন।