আশীষ উর রহমান ঢাকা

সড়কের কিনার ঘেঁষে খাবারের ভ্যানগাড়িতে তৈরি হচ্ছে মুখরোচক নানা পদের কাবাব। গত শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর লক্ষ্মীবাজারে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

জনসন রোডের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয় পেরিয়ে সামনের দিকে তাকালে দৃষ্টি কেড়ে নেয় বাহাদুর শাহ পার্কের কিনার দিয়ে মাথা তুলে থাকা গুলাচিগাছগুলোর শাখা ভরে থাকা থোকা থোকা সাদা ফুলের সমারোহ। উত্তর পাশে গম্ভীরভাবে দাঁড়িয়ে আছে পানির ট্যাংক। এখানে-ওখানে খসে পড়া আস্তরণ আর বিবর্ণ হয়ে আসা লালচে রং জানিয়ে দেয়, বহু বয়স হয়েছে ট্যাংকটির। সেটি পাশ কাটিয়ে খানিকটা পূর্ব দিকে এগোলেই পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী লক্ষ্মীবাজার এলাকা। এরপর আর সবুজের সমারোহ চোখে পড়বে না। দরদালানে আকীর্ণ।

আগে উদ্যানটির নাম ছিল ভিক্টোরিয়া পার্ক, পরে নাম রাখা হয়েছে বাহাদুর শাহ জাফর পার্ক। এখান থেকে পূর্ব দিকে লক্ষ্মীবাজারের ভেতর দিয়ে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ পর্যন্ত বেশ প্রশস্ত সড়কটির নাম সুভাষ বোস অ্যাভিনিউ। এ সড়কই এখন সূত্রাপুর, শিংটোলা, পাতলা খান লেন, গোয়ালনগর, রাজার দেউড়ি, ধোলাইপাড়, শাঁখারীবাজার, কলতাবাজার, তাঁতীবাজার, বাংলাবাজারসহ আশপাশের বাসিন্দাদের একটি মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে। কেনাকাটা, স্কুল-কলেজ, কোচিং সেন্টারে সন্তানদের আনা নেওয়া, বিনোদনকেন্দ্রের রাইডে চড়া বা বিকেলে একটু আড্ডা দিতে তরুণদের পছন্দ প্রশস্ত এ সড়ক।

ঢাকার বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে লক্ষ্মীবাজার এলাকায়। এর মধ্যে সরকারি কাজী নজরুল কলেজ, ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ, সেন্ট গ্রেগরী স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা গভ. মুসলিম হাইস্কুল ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ খ্যাতনামা। সড়কের উত্তর পাশে ডাফরিন মুসলিম হোস্টেল। দক্ষিণে প্রাচীন হলি ক্রস চার্চ, ১৮৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত। পাশেই লক্ষ্মীবাজার শাহি জামে মসজিদ। দক্ষিণ–পশ্চিম দিকে সদরঘাটের দিকে খানিকটা গেলেই পড়বে বাংলাবাজার সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, কলেজিয়েট স্কুল আর পাশেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বলা যায়, লক্ষ্মীবাজারের এই প্রশস্ত সড়কে শিক্ষার্থীদের সমাগম থাকে সারা দিনই।

সড়কটির দুই পাশে নানা ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। উত্তর দিকের সড়কের কিনার দিয়ে শ খানেক খাবারের ভ্যানগাড়ি। দেশি-বিদেশি হরেক রকমের খাবার বানিয়ে গরম-গরম বিক্রি করা হয় এসব দোকানে। ভ্যানের সামনে ও পেছনে ফুটপাত ঘেঁষে টুল ও বেঞ্চ পেতে বসার ব্যবস্থাও আছে। সাধারণত দুপুরের পর থেকেই এসব দোকানে বেচাকেনা বেশ জমে ওঠে। রাত প্রায় ১১টা পর্যন্ত চলে আড্ডা, খাওয়াদাওয়া।

ফাস্ট ফুডের রকমারি দোকান আছে লক্ষ্মীবাজারে। আইসক্রীম বানাতে হাতে বরফ ভাঙার কাজ করছেন দুই তরুণ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

দোসা, নাচোস, নাগামিট, মোমোসহ অনেক রকম খাবার পাওয়া যায় পথের পাশের ‘বিসমিল্লাহ ইন্ডিয়ান ফুড’–এর ভ্যানে। মালিক মহিউদ্দিন নিজেই দুজন কর্মচারী নিয়ে দোকান চালান। স্কুল ছুটির পর বন্ধুদের নিয়ে চিকেন মোমো খেতে এসেছিল সেন্ট গ্রেগরীর শিক্ষার্থী পিনাক রায়। সে জানাল, খাবারের দাম আশপাশের হোটেল-রেস্তোরাঁর চেয়ে কম। এ কারণে এখানকার পথ খাবারের দোকানগুলোতে শিক্ষার্থীরা বেশি আসে। বিক্রেতা জানালেন, এখানে মোমো, দোসা—এসবের দাম ১০০ টাকা। দাম কিছু কম বলে সব ধরনের ক্রেতাই আসেন এখানে। তবে শিক্ষার্থী আর তরুণদের সংখ্যাই বেশি।

পুরান ঢাকার বাসিন্দারা কাবাব বেশি পছন্দ করেন। এখানে কাবাবের দোকান আছে অনেকগুলো। মাহী ফুড কর্নারের ব্যবস্থাপক মো. মহিউদ্দিন জানালেন, তাঁদের এখানে চিকেন রোল, কাঠি কাবাব, টিকিয়া, বটি কাবাব আর তন্দুরি পাওয়া যায়। তন্দুরি ২০ টাকা আর কাবাব ২০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে। অন্থন, চিকেন ললি, মিটবল, চিকেন উইংস, কলিজার শিঙাড়া—এসব তৈরি করে বিক্রি করেন আক্তার আহমেদ। ‘লাইভ পিৎজা’ নামের ভ্যানগাড়ির স্টলে গরম-গরম পিৎজা তৈরি করে বিক্রি করেন মো. আবু সাঈদ। এখানে ১৮০ টাকায় পাওয়া যায় সাত ইঞ্চি আকারের পিৎজা। পানিপুরি আর রাজকচুরিও আছে মামুন শেখের দোকানে। রাজকচুরির দাম ৮০ টাকা আর ১০টি পানিপুরির প্লেট ৫০ টাকা।

পথখাবারের পসরায় ফুচকা-চটপটি থাকবে না, তা হতেই পারে না। বেশ কয়েকটি ফুচকা-চটপটির স্টল আছে লক্ষ্মীবাজারের এই সড়কে। দই-ফুচকার প্লেট ৭০ টাকা, সাধারণ ফুচকা ও চটপটি ৫০ থেকে ৮০ টাকায় পাওয়া যায়।

সড়কের পাশে আছে অনেকগুলো হোটেল-রেস্তোরাঁ; মি. বেকার, টেস্টি ট্রিট, আজওয়া—এমন খ্যাতনামা বেকারির বিক্রয়কেন্দ্র। বিরিয়ানির দোকান ‘ঢাকাইয়া কাচ্চি’তে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বিক্রি বেশ ভালো। ব্যবস্থাপক আলিউর রহমান জানালেন, তাঁদের এখানে প্রতি প্লেট খাসির কাচ্চি ১৬৯ টাকা, মোরগ-পোলাও ১৪০ টাকায় পাওয়া যায়।

পুরান ঢাকায় বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে শরবত ও ফালুদার। পাড়া-মহল্লাগুলোতে রয়েছে অনেক শরবত ও জুস বার। এর মধ্যে বিউটি লাচ্ছি ও ফালুদা অনেক দিনের পুরোনো। লক্ষ্মীবাজারে ডিআইটি মার্কেটের পাশেই রয়েছে বিউটি লাচ্ছি ও ফালুদার দোকান। ব্যবস্থাপক জসিম উদ্দিন জানালেন, ১০৩ বছর চলছে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের বয়স। মূল দোকানটি রায়সাহেব বাজারে। লক্ষ্মীবাজার ও নাজিরাবাজারে তাঁদের দুটি শাখা আছে। এখানে তিনটি পদ বিক্রি হয়। লেবুর শরবত ১০ টাকা গ্লাস, লাচ্ছির গ্লাস ৫০ টাকা আর ফালুদা ১০০ টাকা। বিক্রি হয় প্রচুর। দুপুরে বাংলাবাজারে মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশের দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে এখানে লেবু শরবত পান করতে এসেছিলেন ব্যবসায়ী মো. জুয়েল। তিনি এখানে নিয়মিত ক্রেতা। জানালেন, পুরান ঢাকায় এদের শরবতের আলাদা কদর রয়েছে। এই গরমের সময় এক গ্লাস লেবু শরবত পান করলে শরীর বেশ ঠান্ডা থাকে। তাঁর বাসা সূত্রাপুরে। বাসা থেকে দোকানে যাতায়াতের পথে প্রায়ই এখানে শরবত বা লাচ্ছির গ্লাসে চুমুক দেন।

নানা পদের মুখরোচক খাবারের ভ্রাম্যমাণ দোকান আছে লক্ষ্মীবাজারের অলিগলিতে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

বিকেলে স্কুল-কলেজ ছুটির পর অনেক শিক্ষার্থীকে তাদের অভিভাবকদের নিয়ে ভিড় করতে দেখা গেল বিউটির শরবত ও পাশেই ‘রিফ্রেশ’ নামের জুসের দোকানে। রিফ্রেশে অনেক রকম মৌসুমি ফলের রস, লাচ্ছি, স্মুদি, কোল্ড কফি—এসব বিক্রি হয়। বড়, মাঝারি, ছোট—তিন ধরনের স্বচ্ছ প্লাস্টিকের গ্লাসে বিক্রি হয় এসব পানীয়। দাম ৩০ থেকে ২০০ টাকা। গ্লাসে পানীয় ভরার পর মেশিনে পলিথিনের ঢাকনা দিয়ে মুখ বন্ধ করে গ্লাস আর স্ট্র ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়া হয়। ফলে পথ চলতে চলতে পান করা যায়, ছলকে পড়ে না। বিকেল থেকে অনেকটা রাত পর্যন্ত দোকানটায় ভিড় লেগেই থাকে। স্কুল ছুটির পর সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স গার্লস স্কুলের শিক্ষার্থী শাহরিন আক্তার মায়ের সঙ্গে এসেছিল এখানে। বড় গ্লাসে ৭০ টাকা দামের লেমোনেড নিল একটা। জানাল, বাড়ি ফেরার পথে এখানে প্রায়ই আসে।

ব্যস্ত এই সড়কে ছোট একটি বিনোদনকেন্দ্রও আছে। হলি ক্রস চার্চ পার হয়ে পূর্ব দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলেই এই বিনোদনকেন্দ্র। এখানে বিপণিবিতানের সামনে খানিকটা খোলা জায়গায় বসানো হয়েছে চরকি, নাগরদোলাসহ বেশ কয়েকটি রাইড। অভিভাবকেরা ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে এখানে আসেন।

এই পার্কের পাশেই কথা হয় সূত্রাপুরের তরুণ ব্যবসায়ী সানি চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বললেন, পুরান ঢাকার অধিকাংশ সড়কই সংকীর্ণ। জনসমাগমের মতো ভালো পরিসর এখানে বিশেষ নেই। সড়কটি বেশ প্রশস্ত আর অনেক ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে আশপাশে। শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক ও মহল্লাবাসী এখানে নানা প্রয়োজনে আসেন। খানিকটা সময় কাটান। ফলে খাবারের দোকান ও নানা রকমের দোকানপাট গড়ে উঠছে। লোকজনের মেলামেশা আর সময় কাটানোর জন্য এমন পরিবেশ আরও থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।