[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যু বদলে দিতে পারে ইরানের শাসন কাঠামো

প্রকাশঃ
অ+ অ-

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি | ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

পদ্মা ট্রিবিউন ডেস্ক: ইরান-আজারবাইজান সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করে ফেরার সময় বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। সরকারি গণমাধ্যম বলছে, জরুরি পরিস্থিতির কারণে কপ্টারটি পাহাড়ি ও বনভূমি এলাকায় ‘হার্ড ল্যান্ডিং’ করেছে অর্থাৎ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গতি নিয়ে খাঁড়া ভূমিতে পড়েছে। বৃষ্টি ও কুয়াশার মধ্যে উদ্ধারকাজ কঠিন ছিল। শেষ পর্যন্ত উদ্ধারকর্মীরা যখন বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের কাছে পৌঁছান, তখন সেখানে কাউকে জীবিত পাওয়া যায়নি। রাইসির সঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ানও মারা গেছেন।

রাইসির মৃত্যুর ফলে ইরানের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়বে। ইরানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, জনগণের প্রতিক্রিয়া ও খামেনির পর পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার প্রতিযোগিতাসহ বেশ কিছু বিষয় তাঁর মৃত্যু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে থাকবে।
কে হবেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট

ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনরত দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট রাইসির। এর আগে ১৯৮১ সালে বিদ্রোহী গোষ্ঠী মোজাহেদিন-ই খালকের হাতে নিহত হন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ-আলি রাজাই। তখনকার ইরানের সংবিধানে প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর পর নতুন একজনকে ‘নির্বাচনের’ বিধান ছিল। কিন্তু ১৯৮৯ সালে সংবিধান সংশোধন করে ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে (বর্তমানে আলী খামেনি) সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেয়।

বর্তমান সংবিধানের ১৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট মারা গেলে বা দুই মাসের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে সর্বোচ্চ নেতার অনুমোদনক্রমে ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেবেন। তবে ৫০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে। সংসদের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি ও ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্টের সমন্বয়ে গঠিত কাউন্সিল ৫০ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আয়োজন করবেন। ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্টের মৃত্যু হলে বা তিনি দায়িত্বপালনে অক্ষম হলে সর্বোচ্চ নেতা একজনকে নিয়োগ দেবেন।
 
বাস্তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা খামেনির হাতেই। কারণ প্রধান বিচারপতি তিনিই নিয়োগ করেন, সংসদের এখানে কোনো ভূমিকা নেই। বর্তমান প্রধান বিচারপতি গোলাম-হোসেন মোহসেনি-ইজেই খামেনির অনুগত। স্পিকার মোহাম্মদ-বাগের গালিবাফও তাই। তিনি ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের প্রাক্তন জেনারেল ও তেহরানের প্রাক্তন মেয়র। বহুবার খামেনির আনুকূল্যে বহুবার শাস্তির হাত থেকে বেঁচে গেছেন তিনি। আর বর্তমান প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার তেমন প্রভাবশালী নন। তিনি সর্বোচ্চ নেতার কথাই শুনবেন। সে ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট পদপ্রত্যাশী গালিবারে ইচ্ছাপূরণ হতে পারে।

ষড়যন্ত্র তত্ত্ব: ইরানের জনগণ যা ভাবতে পারে
এটি যদি নিছক দুর্ঘটনাও হয়, তবু ইরানিরা তা ভাববে না। কারণ, তাঁরা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিশ্বাসে অভ্যস্ত। রাইসির ক্ষেত্রে তা ঘটতে পারে। কারণ, ইরানের সঙ্গে ইসরায়েল প্রথম প্রকাশ্য সামরিক সংঘর্ষের পরই হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হলো। এমন প্রেক্ষাপটে অনেক ইরানি ও সম্ভবত সরকার নিজেও হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ইসরায়েলকে দোষারোপ করতে পারে।

আরও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আবির্ভাব হতে পারে বলে মনে করেন ইয়র্ক টাউন ইনস্টিটিউটের ফেলো শে খাতিরি। তিনি বলছেন, অনেক ইরানি রাইসির প্রেসিডেন্ট পদকে ক্যানসারে আক্রান্ত ৮৫ বছর বয়সী খামেনির সফল উত্তরসূরি হওয়ার ‘অডিশন’ হিসেবে দেখে আসছিলেন। কিন্তু খামেনির ছেলেও মোজতবাও বাবার মসনদে বসতে চান। তলে তলে ইরানে উপদলীয় কোন্দল ঘনীভূত হচ্ছিল।

রাইসি দীর্ঘদিন ধরেই প্রভাবশালী রেভুলিউশনারি গার্ডের পছন্দের মানুষ। কিন্তু মোল্লাদের অনেকেই মোজতবার পক্ষে। যার কারণে পাণ্ডিত্য না থাকলেও ইরানের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী বিদ্যাপীঠ কওম সেমিনারিতে প্রভাষক নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। খামেনির ছেলেকে গ্রহণ করে মোল্লারা রাইসির বিপক্ষে অবস্থানের ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন বলে মনে করেন খাতিরি।

গভীরভাবে ভাবলে, রাইসিকে হত্যার প্রেক্ষাপট আছে। কারণ, মোজতবা এখন তার বাবার আশ্রয় পান। কিন্তু খামেনি অসুস্থ হওয়ায় বেশি দিন তা অব্যাহত থাকবে না। অন্যদিকে, রাইসি প্রসিকিউটর-জেনারেল ছিলেন। সবার হাঁড়ির গোপন খবর তাঁর জানা। নির্বাচনী বিতর্কের সময় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে ভয় দেখাতে দুর্নীতির একটি নথি ফাঁস করেছিলেন তিনি। মোদ্দাকথা, রাইসির পক্ষে রাজনৈতিক মাস্তানের মতো আচরণ ও সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান জে. এডগার হুভারের মতো জিম্মি করার সংস্কৃতির চর্চা সম্ভব। রাইসির মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি সুবিধা নিতে পারেন মোজতবা। কারণ, এর ফলে বাবার উত্তরসূরি হতে তাঁর পথে আর দৃশ্যমান কোনো বাধা থাকল না।

পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার দৌড়ে রাইসির মৃত্যু যে প্রভাব ফেলবে
এই মৃত্যুর ফলে অসুস্থ খামেনির বিকল্প খোঁজার জন্য উঠে পড়ে লাগবে রেভুলিউশনারি গার্ড। ১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর সর্বোচ্চ নেতার আসনে বসেন খামেনি। তিনি ছিলেন দুর্বল প্রার্থী। অন্যান্য গোষ্ঠীগুলো তাকে স্বার্থের পথে বড় হুমকি মনে করেনি। কিন্তু পরে তাকে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়। এ জন্য যারা তাকে ক্ষমতার মসনদে বসিয়েছিলেন, সাবধানী কৌশলে তাদের একে একে নির্মূল করে তিনি নিজেকে দীর্ঘমেয়াদি শাসকে রূপান্তরিত করেন।

তবে রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর চেয়ে এখন রেভলিউশনারি গার্ড প্রভাবশালী। এ কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী ও ব্যক্তিরা তেমন পাত্তা পাবে না। আর এই বাহিনীর প্রধান গালিবাফ প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। যদিও তিনি সর্বোচ্চ নেতা হতে পারবেন না। কারণ তিনি ধর্মগুরু নন।

সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে মোজতবার উত্থান হলেও বংশগত শাসন ইরানে রাজনৈতিক জটিলতা তৈরি করবে। কার খোমেনি ও খামেনি-উভয়েই শাহের অধীনে বংশগত শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। মোজতবাকে সর্বোচ্চ নেতা বানাতে গেলে সেই ইরানি জনগণের কাছে বংশগত শাসনকে বৈধ করতে হবে। সেটা বেশ কঠিন কাজ।

১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর প্রথম বছরগুলোতে সর্বোচ্চ নেতার লাগামহীন প্রভাব নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়। ইসলামি প্রজাতন্ত্রে একক সর্বোচ্চ নেতার প্রয়োজন নেই বলে তখন আলোচনা উঠেছিল। কারণ, তাত্ত্বিকভাবে সংবিধানে একদল নেতার সমন্বয়ে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাউন্সিল অনুমোদিত। খামেনি মারা গেলে সেই বিতর্ক আবার নতুন করে জেগে উঠতে পারে। রাষ্ট্র যুক্তি দেখাতে পারে, খোমেনি ও খামেনি ঐশ্বরিক মানুষ ছিলেন, যারা জ্ঞান ও গুণের শিখরে পৌঁছেছিলেন। তাদের শূন্যস্থান এখন কেবল একদল পুরুষের সম্মিলিত প্রতিভাই পূরণ করতে পারে।

তবে এরপরে যাই ঘটুক না কেন, ইরানের রাজনীতিতে ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ খেলার প্রথম ধাপ হবে রাইসির এই ‘হার্ড ল্যান্ডিং’। কয়েক মাস ধরে এই খেলায় ডুবে থাকবে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র। এই ঘটনাপ্রবাহ শুধু রাইসি-পরবর্তী যুগ নয়, খামেনি-পরবর্তী যুগও নির্ধারণ করে দিতে পারে।

তথ্যসূত্র: মিডল ইস্ট ফোরাম, ইরান ইন্টারন্যাশনাল, রয়টার্স।

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন