মিরপুরের উত্থান

মিরাজ হোসেন: মিরপুরের ইতিহাস শতাব্দী ধরে বিস্তৃত। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মতে, ১৬১০ সালে ঢাকা প্রতিষ্ঠার সময় থেকে মিরপুরের উত্থান ঘটে। শুরুতে মিরপুর তুরাগ নদীর পাশে অবস্থিত একটি শান্ত গ্রাম ছিল। মূলত ঢাকায় প্রবেশের জন্য নৌকার টোলঘাট হিসেবে ব্যবহৃত হতো মিরপুর। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ব্যবসার কাজে ডিঙি বা নৌকায় যাতায়াত করে মিরপুরের খেয়া ঘাটে এসে নামতেন।

২০২০ সালে সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে পড়ালেখা বন্ধ করে দেন আরিফুল ইসলাম রিওন।

তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবা বিদেশে ভালো বেতনের চাকরির আশায় ওমানে পাড়ি জমান। কিন্তু হন প্রতারণার শিকার, আটকা পড়েন সেখানে। এর পর দেশে ফিরেও পরিবারের খরচ চালাতে পারেননি আর।

রিওন মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেন এবং স্বজনদের সঙ্গে বসবাসের জন্য রাজধানীর গ্রিন রোড থেকে মিরপুর চলে যান।

কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিয়ে পড়াশোনার খরচ চালাতে থাকেন রিওন। মহাখালী পর্যন্ত যাতায়াতের কষ্ট ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিরপুরের পরিবেশই রিওনের কাছে নিজের জন্য উপযুক্ত মনে হয়েছিল। কিন্তু সে সময় মেট্রোরেল নির্মাণ কাজের জন্য তার কলেজে যাতায়াতের সময় অতিরিক্ত অন্তত এক ঘণ্টা বেড়ে যায়।

এখন অবস্থা বদলেছে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে রিওন বললেন, 'এখন আমি মাত্র ৩৫ মিনিটেই বাসায় ফিরতে পারব। মাথার ওপরে মেট্রোরেল হওয়ায় সচারচর সড়কগুলোতে যান চলাচল অনেক কমে গেছে।'

মেট্রো: মিরপুরের নতুন মেরুদণ্ড
মিরপুরবাসীর জীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে মেট্রোরেল। একইসঙ্গে এ অঞ্চলের সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়েছে। পরিবহণ অবকাঠামোর এ উন্নয়নের ফলে শুধু যাতায়াতই যে সহজ হয়েছে তা নয়, স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যেও উল্লেখযোগ্য উত্থান ঘটেছে।

২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর এক শীতের সকালে মেট্রোর প্রথম ট্রেনটি স্টেশন ছাড়ে। বহু যাত্রীর দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটে ওইদিন। তবে মিরপুরের যাত্রীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন তাদের এলাকার স্টেশন কবে খুলবে সেই দিনটির জন্য।

ঢাকায় মেট্রোরেল সেবা চালুর প্রায় এক মাস পর ২০২৩ সালের ২৫ জানুয়ারি মিরপুরের পল্লবী স্টেশন জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এরপর ১লা মার্চ মিরপুর-১০ এবং ১৫ মার্চ কাজীপাড়া ও মিরপুর-১১ স্টেশনও যাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

অবশেষে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি যখন মেট্রোরেল চলাচলের সময় বাড়িয়ে রাত ৮টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত করা হয় তখন মিরপুরবাসীর চেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত আর মনে হয় আর কেউই হননি।

আক্ষরিক কিংবা রূপক, মিরপুরের বুক দিয়ে চলা মেট্রোকে দুই অর্থেই এর মেরুদণ্ড বলা যায়।

কিন্তু মিরপুর সবচেয়ে বেশি লাভবান কেন?
এর মূল কারণ হলো মেট্রো স্টেশনের সংখ্যা। মেট্রো নেটওয়ার্কের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মিরপুর। শেওড়াপাড়া থেকে পল্লবী পর্যন্ত শুধু মিরপুরেই মেট্রোর পাঁচটি স্টেশন।

মিরপুর-১০ ওভারব্রিজের কাছে মানিক নামে এক ঘড়ির মেকানিক বলেন, 'মেট্রোরেল নির্মাণের সময় আমাদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। কিন্তু এখন আমরা এর সুফল ভোগ করছি।'

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনুন্নয়ন ও বন্যা ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রলের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল মিরপুর। মিরপুরের নামের পাশে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল বসবাসের অযোগ্য এলাকার তকমা। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় 'মিরপুর এ গেলে আপনার চেহারার মেকআপে আরেকটি স্তর তৈরি হয়!'–  এরকম মিমও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকে মিরপুরবাসীর জীবনযাত্রা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। তারা এখন অতীতের কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়েছেন, যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় ব্যবসায়ও ভালো গতি এসেছে।

শতবর্ষ পুরনো গল্প
মিরপুরের ইতিহাস শতাব্দী ধরে বিস্তৃত। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মতে, ১৬১০ সালে ঢাকা প্রতিষ্ঠার সময় থেকে মিরপুরের উত্থান ঘটে। 

শুরুতে মিরপুর তুরাগ নদীর পাশে অবস্থিত একটি শান্ত গ্রাম ছিল। মূলত ঢাকায় প্রবেশের জন্য নৌকার টোলঘাট হিসেবে ব্যবহৃত হতো মিরপুর। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ব্যবসার কাজে ডিঙি বা নৌকায় যাতায়াত করে মিরপুরের খেয়া ঘাটে এসে নামতেন।

মোগল আমলে, 'মীর' অভিজাত ব্যক্তিদের একটি উপাধি ছিল এবং এবং ধারণা করা হয় যে সেই মীরদের জমিগুলোর একটির মধ্যে দিয়ে লোকেরা ঢাকায় প্রবেশ করত। তাই এর নাম হয় মিরপুর। 

১৯৬০ এর দশকে মিরপুর | ছবি: সংগৃহীত

যদিও মিরপুরের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ ছিল না। ওইসময় সায়েন্সল্যাব থেকে মিরপুর পর্যন্ত (বর্তমানে মিরপুর রোড নামে পরিচিত) রাস্তাটিই যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা ছিল।

তবে আজকের মিরপুর দাঁড়িয়ে আছে মিরপুর দরগাকে ঘিরে, যা শাহ আলী মাজার নামেও পরিচিত। কথিত আছে, ইসলাম প্রচারের জন্য বাগদাদ থেকে বেরিয়ে আসা ৪০ জন সাধকের মধ্যে শাহ আলী তাদের মধ্যে একজন ছিলেন।

শাহ আলী এখানে মিরপুরে ঘর বানিয়ে ৪০ দিন ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। তিনি তার শিষ্যদের আদেশ দেন, '৪০ দিনের মধ্যে আমাকে কেউ বিরক্ত করবে না।'

তবে ৩৯ তম দিনে তার ঘর থেকে একটি অদ্ভুত শব্দ আসে। শিষ্যরা ঘরে ঢুকে দেখেন শাহ আলী যেখানে ধ্যানে বসতেন সেই জায়গাটি রক্তাক্ত। শাহ আলী আর নেই। হৈ-চৈ শুরু হলো এবং শিষ্যরা দিনের পর দিন কান্নাকাটি করতে লাগলেন। পরে সেখানে তার সমাধি তৈরি করে ওই ঘরটাকে বানানো হলো শাহ আলীর মাজার। ১৮০৬ সালে নায়েব নাজিম জেসারত খান মাজারটি সংস্কার করেন।

তার মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মাজার জিয়ারত করতে আসেন তার অনুগামীরা। আজও মাজারটি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আয় হয় এখান থেকে।

ধর্ম বিশ্বাসী মানুষদের কাছে শাহ আলী মাজার জনপ্রিয় হতে থাকে। শোনা গেছে বৃষ্টির দিনেও পালকি এবং ডিঙ্গিতে চড়ে ঢাকার নারীরা মাজার দর্শনে আসতেন। আর পুরুষরা গাইতেন মাজার সংগীত। অতীতে মাজারকে ঘিরে শহর বিরল কোনো বিষয় ছিল না, ঠিক যেমনটা শাহজালালের মাজার ঘিরে গড়ে ওঠা সিলেট শহর।

অধ্যাপক মামুন বলেন, 'আমার মনে আছে ১৯৬৩ সালের দিকে আমার খালা বলেছিলেন যে তিনি কিছু মানত (ইচ্ছা) পূরণ করতে মিরপুর দরগায় যাবেন। তার মানে মিরপুরের মাজার তখনও বিখ্যাত ছিল। এটাই আদি মিরপুর। এরপর মিরপুরের অন্যান্য অংশের উন্নয়ন হয়েছে।'

১৯৬০ এর দশকে মিরপুর | ছবি: সংগৃহীত

শুধু মিরপুর থানাতেই ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি এবং প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষের বসতি আছে। ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুসারে দারুস সালাম, কাফরুল, পল্লবী এবং শাহ আলী থানা মিলিয়ে মিরপুরের মোট জনসংখ্যা ১.৮ মিলিয়নেরও বেশি।

আর নগরীর অন্যতম বৃহৎ মিরপুর-১ এর পাইকারি কাঁচাবাজার এই অর্ধ লাখ মানুষকে সতেজ পণ্য সরবরাহ করছে।

স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন কারণে মিরপুরের প্রতি বাইরের মানুষ আকৃষ্ট হয়েছে। ১৯৭৪ সালে মিরপুরে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা স্থাপন করা হয়। ঢাকায় বেড়াতে এসেছে, কিন্তু মিরপুর চিড়িয়াখানা ঘুরেনি এমন শিশু খুঁজে পাওয়া দায়। এরপর ১৯৬২ সালে প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় বোটানিক্যাল গার্ডেন। ২০০৬ সালে শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম উদ্বোধনের মাধ্যমে মিরপুরের খ্যাতি নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। ক্রিকেট জাতীয় আবেগ হওয়ায় মিরপুর দেশ বিদেশে সবার কাছে পরিচিত নাম হয়ে ওঠে।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মিরপুর
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মিরপুর অনেকটা পাকিস্তানপন্থী ছিল। এই অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালিরা পাকিস্তানপন্থী বিহারিদের দ্বারা হুমকি ও আক্রমণের শিকার হয়েছিল।

১৯৫০-এর দশকে বসতি স্থাপন করা বিহারিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও মিরপুরে থেকে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর বিহারি সম্প্রদায়ের লোকরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেও বেশিরভাগ মিরপুর-১১ এলাকা ঘিরে তাদের জীবনযাপন শুরু করে।

অধ্যাপক মামুন বলেন, '১৯৬৯-৭০ সালে আমি যখন পল্লবীতে থাকতাম, তখন মিরপুরে অবাঙালি, বিহারিরা বেড়ে ওঠছিল। এই অংশে আসা অবাঙালিরা মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে তাদের বসতি স্থাপন করে। সেখানে গড়ে তুলে ছোট ছোট ঘর ও ছোট ব্যবসা।'

শ্যামলী ও মিরপুর হয়ে একটি মাত্র রাস্তা ছিল। অন্য কোনো রাস্তার অস্তিত্ব ছিল না। বর্ষা মৌসুমে এই সড়কটি ডুবে যেত। প্রথমে মিরপুর টেকনিক্যাল পর্যন্ত এসে তারপর নৌকায় করে শ্যামলী আসতে হতো।

মামুন স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'শ্যামলী পৌঁছানোর পর আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বাসে উঠতাম।

পল্লবী এলাকায় ইসলাম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা-চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম তার প্রথম আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করেন। প্রথম প্রকল্প হিসেবে তিনি পাঁচটি একতলা ভবন প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই সম্ভবত মিরপুরের মাটিতে প্রথম আধুনিক আবাসন প্রকল্প।

জহুরুল ইসলাম বলেন, 'সেখানে আমার চাচা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর একটি বাড়ি কিনেছিলেন। আমি তাদের সঙ্গে সেখানে থাকতাম। প্রকল্পের চারদিকে ছিল ফাঁকা জমি,  ঢেউখেলানো লাল মাটি। আর পল্লবীর উলটো দিকটা সব ফাঁকা। মিরপুরে তখন এত মানুষের বসবাস ছিল না। সেখানে বিহারি ছিল, আর কিছু বাঙালি পল্লবীর আশেপাশে থাকত।'

১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি মিরপুর পাকিস্তান মুক্ত হয়। স্বাধীনতার পরও প্রায় দেড় মাস মিরপুরবাসীদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছিল।

পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা অবাঙালি বিহারি, রাজাকার, আলবদর ও আল শামসের সহায়তায় বহু বাঙালিকে হত্যা করে লাশ সেপটিক ট্যাংক ও কুয়ায় ফেলে দেয়।

স্বাধীনতার পরে বিহারিরাও মিরপুর থেকে সরে যেতে শুরু করে এবং অনেকে দেশ ছেড়েও চলে যায়। সরকার এই সময়ের মধ্যে আবাসনের জন্য জমি বরাদ্দ করে এবং ধীরে ধীরে বাঙালিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

রাজউক জমি দেওয়ার প্রস্তাব দিলে সেখানে অনেকে বাড়ি বানাতে শুরু করে। বনানী ও বারিধারার মতো এলাকার তুলনায় মিরপুরে জমির দাম কম ছিল। তাই যারা কম দামে ভালো জায়গা খুঁজছিলেন, তাদের জন্য মিরপুর ছিল ভালো পছন্দ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠে আজকের মিরপুর।

আধুনিক মিরপুর
নানা আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও মেট্রোরেল চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত মিরপুরে যোগাযোগ অবকাঠামো দুর্বল ছিল। মেট্রোরেল মিরপুরের জীবনকে বদলে দিয়েছে। এই উন্নয়ন ব্যবসায়ের প্রবৃদ্ধি, আবাসন খাতসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

গত ১৫ বছর ধরে মিরপুর-১০ নম্বরের কুরিয়ার রোডের চটপটি বিক্রি করা আবু তাহের জানান, মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকে এদিকে মানুষের আগমন বেড়েছে।

তার ভাষ্য, 'আপনি দেখতে পাচ্ছেন এখানে প্রচুর ভিড় বেড়েছে। মাত্র কয়েক মাস আগেও এখানে খুব বেশি হালিম ও কাবাব বিক্রির গাড়ি ছিল না। এখন সবগুলো গাড়ি এই রাস্তা ধরে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে।'

লক্ষ্মীপুর ট্রেডার্সের হার্ডওয়্যার দোকানের মালিক মোজাম্মেল হক বলেন, 'মেট্রো ব্যবহার করে যারা অফিসে যান, মূলত তারাই মেট্রোর সব থেকে বেশি সুবিধাভোগী। এ এলাকায় এখন আবাসন ভাড়াও বেড়েছে। আমার দোকানের মালিকও ভাড়া বাড়ানোর কথা ভাবছেন।'

মেট্রোরেল নির্মাণের সুযোগে আরও কিছু উন্নয়ন হয়েছে। আগে রোড ডিভাইডারের জায়গায় মানুষজন প্রস্রাব করত। কিন্তু এখন এই জায়গাগুলো যেমন পরিষ্কার আছে, তেমনি নিচের রাস্তারও উন্নতি হয়েছে।

রিওন বলেন, 'গত তিন বছর ধরে আমি এই এলাকায় আছি। মেট্রোরেল কিছু বাড়তি উন্নয়ন এনেছে। যে বিষয়টি আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে তা হলো রাস্তার ডিভাইডারগুলো এখন পরিষ্কার এবং পুরো রাস্তাটি আরও সুন্দর।'

মিরপুরজুড়ে নতুন নতুন ভবন, শপিংমল ও রেস্তোরাঁও গড়ে ওঠেছে। পল্লবী মেট্রো স্টেশন থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামলেই সাফুরা টাওয়ার। ভবনটি গত বছর চালু হলেও এর বেশিরভাগ তলা এতদিন ফাঁকা ছিল। তবে গত কয়েক মাসে এখানে একের পর এক নতুন রেস্তোরাঁ চালু হয়েছে।

পল্লবী মেট্রোরেল স্টেশনের কাছে একটি বহুতল ভবনে নতুন নতুন রেসোরাঁ গড়ে উঠেছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

নয়তলা ভবনটিতে ঢোকার সময় দেখা যায়, ভবনের দুটি লিফটের জন্য অপেক্ষা করছেন এক সারি মানুষ।

দুই মাস আগে চালু হওয়া অ্যারাবিয়ান রেস্টুরেন্টের মালিক বেলায়েত হোসেন বলেন, 'মিরপুর সব সময়ই মানুষে জমজমাট থাকে। মেট্রো চালু হওয়ায় এটি এখন আরও ব্যস্ত হবে। এ কারণেই রেস্টুরেন্টটি এখানে দেওয়া। কিন্তু আমরা এখনও ব্যবসায় সেই প্রত্যাশিত সাফল্য পাইনি।'

সাফুরা টাওয়ারের পশ লাউঞ্জের মালিক মাত্র এক মাস আগে রুফটপ রেস্তোরাঁটি চালু করেছেন। তাদের ভিজিটিং কার্ডের ঠিকানাতেও রেস্তোঁরাটিকে 'পল্লবী মেট্রো স্টেশনের পাশে' বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।

মালিক মেহেদি হাসান বুলবুল বলেন, 'যেহেতু মেট্রো স্টেশন আছে, সেহেতু দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ আসতে পারে, তাই আমাদের ব্যবসায় এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা।'

রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি কাপড়ের দোকান ও ক্যাফেও গড়ে ওঠেছে মিরপুরজুড়ে।

অধ্যাপক মামুন বলেন, 'কিছুদিন আগে মিরপুর গিয়েছিলাম। যা দেখেছি তা অবিশ্বাস্য, কিছুই চিনতে পারিনি।'

মিরপুর উত্তরার মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মেট্রোরেল হওয়ার আগে, মিরপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বলার মতো উন্নয়ন ছিল বেগম রোকেয়া সরণি রোড। বেগম রোকেয়া সরণি রোড ও বিআরটিসি বাসগুলো তখন কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিল মিরপুরবাসীকে।

তবে মেট্রোর কারণে লোকাল বাস মালিকদের ব্যবসা চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে এখন।

মিরপুর লিংক বাসের লাইন ম্যানেজার মোহাম্মদ কচি বলেন, 'যাত্রী কমে যাওয়ায় কিছু বাস মালিক তাদের বাস এই রুট থেকে সরিয়ে নিয়েছেন এবং অবস্থা দিন দিন আরও খারাপের পথে।'

মিরপুর ১২ নম্বর থেকে যাত্রাবাড়ী যাওয়া শিখর বাসের চালক আফজাল হোসেন বলেন, 'সব খরচের পর বাসের মালিকের কাছে প্রতিদিন ২৫০০ থেকে ২৬০০ টাকা থাকত। এখন দুই হাজার টাকা পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের অনেককেই এই পেশা ছেড়ে দিতে হতে পারে।'

তবে শতাব্দী জুড়ে মিরপুর ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়েছে। মিরপুরে এখন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, পার্ক, চিড়িয়াখানা, স্টেডিয়াম, রান্নাঘরের বাজার, শপিং মল এবং সিনেপ্লেক্সসহ সকল প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।

আর উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতায় আশীর্বাদ হয়ে এসেছে মেট্রোরেল।