কৃষক সোহেল বাঁচাতে চান পঙ্খিরাজ, ভাষামানিকসহ ১০ জাতের ধান
![]() |
| ‘আদান-প্রদান’ কৃষি খামারে ধানখেতে কৃষক সোহেল রানা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
দাদখানি, পঙ্খিরাজ, ভাষামানিক, দোলাভোগ, এলাইসহ অসংখ্য জাতের ধান এখন চোখে পড়ে না। অনেক কৃষকই এসব ধানের নাম ভুলতে বসেছেন। ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের ভাদড়া গ্রামের ‘আদান-প্রদান’ নামে এক কৃষি খামারে মো. সোহেল রানা হারিয়ে যেতে বসা ১০টি ধানের জাত চাষ করেছেন।
সোহেল রানা এই খামারে দেড় শতাংশ করে ১০টি প্লটে মোট ১৫ শতাংশ জমিতে ওই ১০টি ধানের চাষ করেছেন। তিনি বলেন, হারিয়ে যেতে বসা ধানগুলো বাঁচিয়ে রাখতেই এ উদ্যোগ। এ বছর সামান্য জমিতে চাষ শুরু করেছেন, ভবিষ্যতে পর্যাপ্ত বীজ তৈরি করে আরও বেশি জমিতে চাষ করার পরিকল্পনা আছে। পাশাপাশি আরও কিছু হারিয়ে যেতে বসা ধানের বীজ সংগ্রহ করে চাষ করার ইচ্ছা আছে তাঁর।
সোহেল রানার জীবনের গল্পও অনুপ্রেরণাদায়ক। তিনি হরিণাকুণ্ডুর দুর্লভপুর গ্রামের মৃত গোলাম রব্বানীর ছেলে। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাইমারি ও মাধ্যমিক শেষ করে ঝিনাইদহ শহরের কেসি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করার পর একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় চাকরি নেন। কিছুদিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পর বর্তমানে তিনি ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশ’-এ বৈশ্বিক পুষ্টি প্রকল্পের কো-লিডার হিসেবে কর্মরত।
সোহেল রানা জানান, বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন, আমাদের দেশের মধ্য থেকে পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ অনেক ধানের জাত হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো গবেষণা ও আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। কিন্তু আমরা নতুন নতুন জাতের ধান চাষ করি, হারিয়ে যেতে বসা জিংকসমৃদ্ধ ধান হারিয়ে যাই। এভাবেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, হারিয়ে যাওয়া ধান চাষের মাধ্যমে এগুলো ফিরিয়ে আনবেন। স্থপতি খন্দকার হাসিবুল কবির, স্থপতি সুহায়েলী পারভিন ও শিক্ষক আলমগীর কবিরের সহায়তায় তিনি খামার প্রতিষ্ঠা ও বীজ সংগ্রহ শুরু করেন। খামারের লক্ষ্য হলো নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, দেশি বীজ সংরক্ষণ, কৃষি পরিবেশ রক্ষা ও স্থানীয় জ্ঞানের ব্যবহার।
মাসুদ রানা জানান, প্রথমে ভাদড়া গ্রামের মাঠে ৫ বিঘা জমিতে খামার প্রতিষ্ঠা করেন। ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে খামারের নাম দেন ‘আদান–প্রদান’। এরপর পাবনা, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী এলাকা থেকে পঙ্খিরাজ, দাদখানি, বেগুনবিচি, ভাষামানিক, কলমকাটি, দোলাভোগ, এলাই, রানাশাইল, পরাঙ্গী, কৃষ্ণকলি নামের ১০টি জাতের বীজ সংগ্রহ করেন। বীজ পাওয়ার পর জমি তৈরি করে চাষ শুরু হয়। চলতি আউশ মৌসুমে ১০টি প্লটে মোট ১৫ শতাংশ জমিতে ধান চাষ হচ্ছে, বর্তমানে ধান পাকতে শুরু করেছে। অল্পদিনের মধ্যে ধান কেটে বীজ তৈরি হবে।
প্রতিটি ধানের ফলন বিঘায় ১৪–১৫ মণ। এগুলো পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ, তাই বাজারে বেশি দাম পাওয়া যায়। রানাশাইল ধান সম্পূর্ণ লাল চালের, যা চিকিৎসকরা খাওয়ার পরামর্শ দেন। প্রথম বছর চাষ হলেও সোহেল রানা আশা করছেন, বীজ তৈরি করে ভবিষ্যতে আরও বেশি জমিতে চাষ করা সম্ভব হবে। ৭০-এর দশক থেকে বোরো ধান চাষ শুরু হওয়ার পর এই জাতগুলো কমতে শুরু করে। ৭৫–৮৫ দিনের জীবনকাল থাকা এই ধানগুলো দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে মানানসই, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার কম লাগে।
কবি যোগীন্দ্রনাথ সরকারও কবিতায় দাদখানি চালের কথা উল্লেখ করেছেন। বেগুনবিচি সুগন্ধিযুক্ত, দেখতে বেগুনের বিচির মতো গোল। কলমকাটি লম্বা ও সরু, অতিথি আপ্যায়নের জন্য ব্যবহার হয়।
ভাদড়া গ্রামের কৃষক আমিরুল ইসলাম জানান, খামারে পুরোনো দিনের ধানের চাষ হচ্ছে জানতে তাঁরা মাঝেমধ্যেই দেখতে আসেন। ধানগাছ ভালো হয়েছে, এখন ফলন কেমন হবে, সেটা দেখার অপেক্ষায়। বাজারে বিক্রিমূল্য ঠিক থাকলে ভবিষ্যতে তাঁরাও চাষ করবেন। ইতিমধ্যে বীজ চেয়ে রেখেছেন।
ঝিনাইদহ কৃষি বিভাগের উপপরিচালক মো. কামরুজ্জামান বলেন, এসব ধানের জাত কৃষিক্ষেত্রে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। গবেষণায় এগুলো কাজে লাগে। যদিও ফলন কম, তাই কৃষক চাষে আগ্রহী হন না। দেশের মানুষের খাদ্যের চাহিদা অনুযায়ী ধান গবেষণা বিভাগ অধিক ফলনশীল জাত আবিষ্কার করছে। তবে সোহেল রানার উদ্যোগ প্রশংসনীয়।

Comments
Comments