মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থলে হারিকেনের আলোয় হতো গোপন বৈঠক
গভীর রাত, কাঁপা কাঁপা হারিকেনের আলোয় ফিসফিসিয়ে কথা বলছিলেন কয়েকজন তরুণ। গোল হয়ে বসে ছক কষছিলেন। তৈরি হচ্ছিল অপারেশনের নিখুঁত পরিকল্পনা। এই সময়ে খাবার এলো। মাটিতে চাটাই বিছিয়ে খেতে বসেছিলেন সবাই। সবার চোখে-মুখে কেমন কঠিন এক সংকল্প দেখা যাচ্ছিল।
আড়াই শ বছরের পুরোনো জীর্ণ দোতলা বাড়িটিতে একাত্তরে এভাবেই রাত ঘনিয়ে আসত। দালানটি আজও জরাজীর্ণ। লালচে ইটের গায়ে সময়ের ক্ষয় স্পষ্ট। দরজা-জানালা ভাঙা, ছাদের পলেস্তারা খসে পড়েছে। তবু বাড়িটি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে—ইতিহাসের ভার কাঁধে নিয়ে। দেয়াল, বারান্দা, ঘর আর উঠানজুড়ে ছড়িয়ে আছে একাত্তরের স্মৃতি। এই বাড়ির প্রতিটি ইট যেন সাক্ষ্য দিচ্ছে সাহস, ত্যাগ আর মানবিকতার।
এই ইতিহাসের খোঁজে ফিরতে হয় ৫৪ বছর পেছনে, ১৯৭১ সালে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িটিতে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আশ্রয়। চট্টগ্রাম নগরের ৩৮ নম্বর দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডের ঈশান মিস্ত্রি হাট এলাকা। হাট থেকে আধা কিলোমিটার দূরে হাজি মালুম বাড়ি। এখানেই দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আশ্রয় নিতেন মুক্তিযোদ্ধারা। অপারেশনে যেতেন, ফিরে আসতেন আবার এই বাড়িতেই। ক্লান্ত শরীর আর অস্থির মন নিয়ে তাঁরা এখানে খুঁজে পেতেন খানিকটা নিরাপত্তা।
বাড়িটির দেখভাল করতেন এজাহার মিয়া। বয়স এখন ৯০। শরীর ভেঙে পড়েছে বয়সে, কথা বললেই হাঁপিয়ে ওঠেন। নানা রোগ তাঁকে ঘিরে ধরেছে। তবু একাত্তর তাঁর কাছে এখনো জীবন্ত, স্পষ্ট, দগদগে। চোখে তাকালেই বোঝা যায়, সেই সময় তিনি এখনো বয়ে বেড়ান।
বাড়িটির দেখভাল করতেন এজাহার মিয়া। বয়স এখন ৯০। গতকাল সোমবার দুপুরে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি আমাদের বসালেন পুরোনো বাড়িটির একটি ঘরে। বয়সে শরীর ভেঙে পড়েছে, কথা বললেই হাঁপিয়ে উঠেন। নানা রোগ তাঁকে ঘিরে রেখেছে। তবু একাত্তর তাঁর কাছে এখনো জীবন্ত, স্পষ্ট ও দগদগে। চোখে তাকালেই বোঝা যায়, সেই সময় তিনি এখনো মনে করেন।
এজাহার মিয়া ছিলেন গানপাগল মানুষ। পাকিস্তান আমলে গান গেয়েই তিনি রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। কথা বলতে বলতে কয়েকটি গানও গেয়ে শোনালেন। কণ্ঠে বয়সের ভার, কিন্তু সুরে এখনো প্রতিবাদের স্পষ্ট ছাপ। গান থামলে তাঁর চোখে ভেসে ওঠে পুরানো দিনের দৃশ্য।
এজাহার মিয়া আমাদের নিয়ে গেলেন দালানের দ্বিতীয় তলার বারান্দায়। খোলামেলা বারান্দা, কারুকার্যময় দেয়াল। দুই পাশ দিয়ে আলো-বাতাস ঢোকে। এজাহার মিয়া বললেন, এখানেই রাতে মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুমোতেন মুক্তিযোদ্ধারা। তখন বিদ্যুৎ ছিল না, হারিকেনের আলো জ্বলত। গোল হয়ে বসে তাঁরা যুদ্ধের কৌশল ঠিক করতেন, পরের দিনের পরিকল্পনা সাজাতেন। বারান্দার পাশের দুটি বড় ঘরেও বেতের পাটি পেতে থাকতেন অনেকে।
১৯৩৫ সালে জন্ম এজাহার মিয়ার। ১৯৫৯ সালে বিয়ে করেন শামসুন্নাহার বেগমকে। দুই বছর আগে ৭৫ বছর বয়সে মারা গেছেন তাঁর স্ত্রী। একাত্তরের দিনগুলোতে এই দম্পতিই ছিলেন বাড়ির ভরকেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধারা থেকেছেন এই বাড়িতে। হিসাব করলে প্রায় এক হাজার মুক্তিযোদ্ধার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল এখানে। রান্নাবান্নার কাজ করতেন শামসুন্নাহার বেগমসহ পরিবারের নারী সদস্যরা। ভয়, অনিশ্চয়তা, অভাব—কিছুই তাঁদের ক্লান্ত করতে পারেনি।
![]() |
| প্রায় আড়াই শ বছরের পুরোনো মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই। গতকাল বেলা দেড়টায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
পুরো বাড়িতে আছে ১০-১১টি কক্ষ। পুরোনো দিনের আসবাব এখনো ছড়িয়ে আছে এদিক-ওদিক। নিচতলায় মাটির চুলায় রান্না হতো। বাড়ির সামনেই পুকুর। এজাহার মিয়া বললেন, অস্ত্র লুকানো হতো সেই পুকুরেই। বস্তায় পলিথিন মুড়িয়ে দড়ি বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হতো অস্ত্র। প্রয়োজন হলে দড়ি টেনে তুলে আনা হতো। বাড়ির পাশের মসজিদ আর হালিশহর মোহর আফজল উচ্চবিদ্যালয়েও কখনো কখনো মুক্তিযোদ্ধাদের থাকার ব্যবস্থা করা হতো।
কথার ফাঁকে এজাহার মিয়া ইতিহাসের আরও পেছনে ফিরে গেলেন। বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, বৈষম্য, নিপীড়ন আর গণহত্যার ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তান আমলেই তাঁরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীকে জুতা আর ঝাড়ু দেখানোর ঘটনাও তাঁর স্মৃতিতে গাঁথা। সেই প্রতিবাদের পথ ধরেই একাত্তরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধে।
এই বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই। কেউ শহীদ হয়েছেন, কেউ যুদ্ধ শেষে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। এজাহার মিয়া কয়েকজনের নাম মনে করতে পারলেন—বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই ফয়েজুর রহমান, সাংবাদিক সাবের আহম্মদ আসগরী, আইয়ুব আলী, আবদুল খালেক, মোহাম্মদ মালেক।
মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে বিপদের মুখেও পড়তে হয়েছে তাঁকে। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর—এই তিন মাস ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর। ওই সময় চলাফেরা সীমিত হয়ে যেত। ভোর ও গভীর রাতে যোগাযোগ চলত। কখনো বোরকা, কখনো শাড়ি পরে রাস্তায় হাঁটতে হয়েছে নজর এড়াতে। তবু পিছপা হননি।
সবচেয়ে বড় ত্যাগ ছিল আর্থিক। কথায় কথায় জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পরিবারের ১৮ ভরি সোনা বিক্রি করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়াতে ঋণও করতে হয়েছিল। আশপাশের পুকুর থেকে মাছ তুলে খাবারের ব্যবস্থা হতো। কোনো হিসাব-নিকাশ ছিল না, ছিল শুধু দায়বোধ।
এজাহার মিয়ার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। এক ছেলে মারা গেছেন ২০১২ সালে। এখন নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটে। তাঁরা শুনে থাকে তাঁর একাত্তরের গল্প।
পুরোনো দালানে থাকার পরিবেশ নেই। ২০১৪ সালের দিকে পরিবার নিয়ে তিনি উঠেছেন পাশের একটি ফ্ল্যাটে। সেই ফ্ল্যাটের দেয়ালজুড়ে টাঙানো অসংখ্য ছবি। ছবিগুলো যেন জীবনের নানা ঐতিহাসিক মুহূর্তের নীরব দলিল। ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি ভেঙে পড়েন কান্নায়। চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, তাঁর স্ত্রী সারা জীবন তাঁকে সাহস জুগিয়েছেন। আজ তিনি নেই।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক মাহফুজুর রহমান জানান, হাজি মালুম বাড়ি একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম বড় আশ্রয়স্থল ছিল। এখান থেকে প্রচারপত্র বিলি হয়েছে, কৌশল ঠিক হয়েছে, প্রশিক্ষণও নিয়েছেন অনেকে। চারজন সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষক ছিলেন। তাই এই বাড়ি শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি ইতিহাস।


Comments
Comments