ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে কেবল ১৯% পাচ্ছে ভাতা সুবিধা
| সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি |
প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও হতদরিদ্রদের জন্য সরকারের চলমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষরা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পাঁচটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, এসব কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে মাত্র ১৯.৭ শতাংশই সুবিধা পাচ্ছেন।
গবেষণার ফলের ভিত্তিতে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার বিস্তারিত তুলে ধরেন টিআইবির রিসার্চ ফেলো রাজিয়া সুলতানা। তিনি জানান, ২০২৪ সালের জুন থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত এ গবেষণার কাজ চলেছে। সমতল থেকে ২২টি ও পাহাড় থেকে ৭টিসহ মোট ২৯টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর এ গবেষণা করা হয়েছে। এসব সম্প্রদায় হলো চাকমা, মারমা, গারো, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, গঞ্জু, বাগদু, পাত্র, খাসিয়া, ওঁরাও, রাখাইন, গোরাইত, ম্রো, বম, কোচ, মুন্ডা, মাহাতো, মালপাহাড়ি, রাজোয়ার, ভূমিজ, সাঁওতাল, হুদি, বর্মন, কুরমি মাহাতো, মাহালি, কোরা, মণিপুরি ও বেদিয়া মাহাতো।
গবেষণায় দেখা গেছে, আদিবাসী অধ্যুষিত ১০টি ইউনিয়নে বয়স্ক ভাতার জন্য যোগ্য ছিলেন ১ হাজার ৬৭৬ জন। এঁদের মধ্যে সুবিধা পাচ্ছেন মাত্র ৩৫৫ জন, যা ২১ দশমিক ২ শতাংশ।
প্রতিবেদন বলছে, ৮টি ইউনিয়নে বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত ভাতার জন্য যোগ্য ছিলেন ৪৯৮ জন। কিন্তু সুবিধা পাচ্ছেন মাত্র ৬০ জন, যা ১২ শতাংশ। ৭টি ইউনিয়নে প্রতিবন্ধী ভাতা ও উপবৃত্তির জন্য যোগ্য ছিলেন ৫৮৩ জন, কিন্তু দেওয়া হয়েছে ১৮৪ জনকে, যা ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ। ছয়টি ইউনিয়নে মা ও শিশুসহায়তা ভাতার জন্য যোগ্য ছিলেন ৫৯৪ জন, এ সুবিধা পাচ্ছেন ১২৮ জন, যা ২১ দশমিক ৫ শতাংশ। চারটি ইউনিয়নে ভালনারেবল উইমেন বেনিফিটের (ভিডব্লিউবি) জন্য যোগ্য ছিলেন ১ হাজার ৩৩৮ জন, কিন্তু সুবিধা পাচ্ছেন ১৬৬ জন, যা ১২ দশমিক ৪ শতাংশ।
২০১০ সালের খানা ব্যয় জরিপের তথ্য উদ্ধৃত করে গবেষণায় বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির হার ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ, যেখানে জাতীয় পর্যায়ে এটি ২৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
প্রচার-প্রচারণার অভাবের কারণে অনেক আদিবাসী এসব সুবিধার কথা জানেন না। ফলে অনেকে আবেদন করতে পারেন না। যারা আবেদন করেন, তাদের অনেককে হয়রানি, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও যাচাই-বাছাই, এবং নির্বাচনে অনিয়মের কারণে বাদ পড়তে হয়।
২০২২ সালের একটি খানা আয়-ব্যয় জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, জাতীয় দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এটি ৬৫ শতাংশ। সমতল এলাকায় আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় দারিদ্র্যের হার ৮০ শতাংশ।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী—পার্বত্য অঞ্চলে হোক বা সমতলে হোক—তাদের অধিকার বিবেচনায় নিয়ে, ন্যায্য প্রাপ্য নিশ্চিত করার কর্মসূচিগুলো এই গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি বলেন, ৭টি নির্দেশিকার ওপর ভিত্তি করে গবেষণা চালানো হয়েছে, যেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে সুশাসনের ঘাটতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব, দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও একই ধরনের সমস্যা রয়েছে জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ চিত্র দীর্ঘকাল ধরে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় বিদ্যমান। তার মধ্যেও আদিবাসীদের বিষয়টি আলাদা গুরুত্বের দাবি রাখে। তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে প্রান্তিক, অথচ তাদের ন্যায্য প্রাপ্য রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারছে না।
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, উন্নয়ন, সমাজ পরিবর্তন, সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তার মূলধারায় আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্তি সম্ভব হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের অঙ্গীকার ছিল কৌশলগত প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা, যা হয়নি। সমতলের আদিবাসীদের জন্য আলাদা ভূমি কমিশন করারও অঙ্গীকার ছিল, সেটিও হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির এক্সিকিউটিভ ম্যানেজমেন্টের উপদেষ্টা সুমাইয়া খায়ের, আউটরিচ ও কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, এবং রিসার্চ পলিসির পরিচালক মো. বদিউজ্জামান।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন