[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

ভোট সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ

প্রকাশঃ
অ+ অ-
রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকার বক্স কালভার্ট সড়কের এই জায়গায় ওসমান হাদিকে গুলি করা হয়। শুক্রবার বিকেলের চিত্র | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন    

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে—এমন আশা করা হয়েছিল। তবে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলির ঘটনায় সেই দৃশ্যপট বদলে গেছে। এ ঘটনায় সম্ভাব্য প্রার্থীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক নেতা ও জুলাই যোদ্ধারাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সরকার নিরাপত্তা জোরদারের আশ্বাস দিলেও এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনী প্রচার চালানো নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সময়মতো কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ার ফলেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমন হয়েছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সবাইকে উদ্বিগ্ন করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এখনই দৃশ্যমান ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।

ওসমান হাদি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গত শুক্রবার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে প্রকাশ্যে মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তরা ব্যাটারিচালিত রিকশায় বসা ওসমান হাদির মাথায় গুলি করে। তাঁকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মেডিকেল বোর্ড জানিয়েছে, তাঁর সার্বিক অবস্থা এখনো অত্যন্ত আশঙ্কাজনক।

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চোরাগোপ্তা হামলা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও নাশকতার আশঙ্কার মধ্যে এই ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে থমথমে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল, সেটিও অনেকটাই কমে গেছে।

সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠপর্যায়ের সদস্যদের সতর্ক থাকতে বলেছে। একই সঙ্গে মাঠপর্যায় থেকে সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়গুলো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। গত শনিবার পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) সঙ্গে দেশের সব রেঞ্জের ডিআইজি ও মহানগর পুলিশের কমিশনারদের বৈঠকেও এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং করণীয় নির্ধারণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কোনো প্রার্থী নিজেকে অনিরাপদ মনে করলে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হবে।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল রোববার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ওই বৈঠকেও চোরাগোপ্তা হামলা ও জামিনে মুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিষয় উঠে আসে। বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করে ভবিষ্যতে নিরাপত্তা পরিকল্পনা আরও কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। তবে নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই বলে জানানো হয়েছে।

এদিকে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় প্রধান দলগুলো আবার এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণাও আসে। ওই বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

এর আগে গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এরশাদউল্লাহর গণসংযোগের সময় গুলিতে একজন নিহত হন এবং প্রার্থীসহ দুজন আহত হন। সেখানে হত্যার লক্ষ্য ছিলেন সন্ত্রাসী সরোয়ার। পরে ২৭ নভেম্বর পাবনা-৪ আসনে জামায়াতের মনোনীত প্রার্থী আবু তালেব মণ্ডলের গণসংযোগকে কেন্দ্র করে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক বিরোধকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনাটি ভিন্ন। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যেই গুলি করা হয়েছে। এ ঘটনার পর কোনো কোনো দল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও তোলে।

রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, কয়েক দিন ধরে বাসে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল হামলার মাধ্যমে আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা চলছে। তবে ওসমান হাদির ওপর হামলার পর নির্বাচনের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নির্বাচন যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে বলে মত দিচ্ছে দলগুলো।

অনেক রাজনীতিক মনে করছেন, ওসমান হাদির ওপর হামলা নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার একটি সুপরিকল্পিত চেষ্টা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরেই একটি পক্ষ নির্বাচন ঠেকানোর হুমকি দিয়ে আসছিল।

অন্তর্বর্তী সরকারও ঘটনাটিকে নির্বাচনবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক বিবৃতিতে বলেন, নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের সহিংসতা বরদাশত করা হবে না। জনগণের নিরাপত্তা ও প্রার্থীদের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।

সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, কোথায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও শত্রুতা বেশি এবং কোথায় শক্ত প্রার্থী রয়েছেন—এসব জায়গায় আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এ ধরনের ঘটনা যেকোনোভাবেই প্রতিরোধ করতে হবে। তিনি বলেন, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও চ্যানেলগুলো সক্রিয় করতে হবে এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এদিকে প্রার্থীদের নিরাপত্তা দিতে শনিবার আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট-২’ শুরুর ঘোষণাও দিয়েছেন। একই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সব রাজনৈতিক দলের জন্য পুলিশ নিরাপত্তা প্রটোকল দেবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে আওয়ামী লীগের শাসনামলে যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র ছিল, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে পেশাদার সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। এসব নির্দেশনার আলোকে অবৈধ অস্ত্রের সরবরাহপথ ও অর্থের জোগানদাতাদের শনাক্ত করতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ শুরু করেছে।

এদিকে গত বছরের ৫ আগস্ট পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে জোর দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, লুণ্ঠিত ১ হাজার ৩৩৭টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি, যার মধ্যে প্রায় ৪০০টি পিস্তল রয়েছে। সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র প্রবেশের আশঙ্কা এবং লুট হওয়া অস্ত্র কোনো অপরাধে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না—এ বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদারের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা ও জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।

পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশের নিরাপত্তা পরিকল্পনা নতুন করে সাজানো হচ্ছে। যেকোনো মূল্যে প্রার্থী ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, নির্বাচনের সময় যেকোনো ঝুঁকি মোকাবিলা করতে এবং নির্বাচনকে শঙ্কামুক্ত রাখতে সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রার্থীদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তিনি জানান, প্রার্থীদের সঙ্গে সশস্ত্র প্রহরী থাকবে এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সম্ভাব্য ঝুঁকি ও দুর্বলতা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় সতর্কতা দেবে। কোথায় যাওয়া নিরাপদ বা ঝুঁকিপূর্ণ—সে সম্পর্কেও প্রার্থীদের নির্দেশনা দেওয়া হবে।

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন