কেন বাংলাদেশের মানুষ বই পড়তে আগ্রহী নয়?
![]() |
| অমর একুশে বইমেলায় এক পাঠক | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন কর্তৃক পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, বই পড়ার ক্ষেত্রে ১০২ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান করছে ৯৭তম। বাংলাদেশের নিচে থাকা দেশগুলো হলো ইউএই, সৌদি আরব, পাকিস্তান, ব্রুনেই ও আফগানিস্তান। আর পাঠাভ্যাস তালিকার শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ইতালি। এ ছাড়া পাঠাভ্যাসের ক্ষেত্রে উপরের দিকে থাকা এশীয় দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে তাইওয়ান (১২), সিঙ্গাপুর (১৪), হংকং (১৫), চীন (১৭), ইসরায়েল (২০), থাইল্যান্ড (২১) ও ইরান (২২)।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ কেন বই পড়তে চায় না? প্রকৃত কারণ জানতে হলে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট জরিপভিত্তিক গবেষণা। কিন্তু সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে এখনও কোনো জরিপ, সমীক্ষা বা গবেষণা চালানোর উদ্যোগ নেয়নি। এ দেশে বই পড়ার অভ্যাস মূলত দুর্বল—একটি দেশের জন্য যা স্বাভাবিক, বিশেষত যেখানে শিক্ষার মান পিছিয়ে আছে।
সৈয়দ মুজতবা আলী ৭৩ বছর আগে হতাশ হয়ে লিখেছিলেন, ’প্রকৃত মানুষ জ্ঞানের বাহন পুস্তক জোগাড় করার জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করে। একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া।’ (বই কেনা, পঞ্চতন্ত্র, ১৩৫৯ বঙ্গাব্দ)। তিনি যতই বই পড়ার পক্ষে উদাহরণ ও পরামর্শ দিন, এ দেশের মানুষ সেই পথে হাঁটতে আগ্রহী নয়। তাই বইয়ের দোকানে উপহার হিসেবে প্রস্তাব দিলে অনেকের মুখে শোনা যায়, ’সেও তো ওর একখানা রয়েছে’। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এক বইই যথেষ্ট।
গত সাত দশকের ব্যবধানে বই পড়া ও কেনার অভ্যাস আরও করুণ ও হতাশাজনক পর্যায়ে নেমেছে। শিক্ষার মান এতটাই কমে গেছে যে শিক্ষিত মানুষের কাছে বই পড়ার কোনো প্ররোচনা নেই। এছাড়া অধিকাংশ মানুষ এখন ব্যস্ত ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পাঠাভ্যাসের তালিকায় বাংলাদেশ ৯৭তম হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে দেশটি অষ্টম স্থানে। অথচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উদ্ভাবক যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে জনসংখ্যা বাংলাদেশের দ্বিগুণ, সেই দেশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শীর্ষে নেই।
এ তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয়, চরিত্রগতভাবেই বাংলাদেশের মানুষ ব্যাপকভাবে অপাঠানুরাগী, জ্ঞানবিমুখ, অলস ও আসক্তিপ্রবণ। এ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু ভূমিকা রাখতে পারত, কিন্তু তা করেনি। বরং কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বেঙ্গল বই, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এ ক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশের কতসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বতন্ত্র গ্রন্থাগার আছে বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কতটা উদ্বিগ্ন, সে ব্যাপারে স্পষ্ট তথ্য নেই। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠাভ্যাস না গড়ে উঠলে, জীবনজুড়ে তা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কম। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের তেমন তৎপরতা নেই।
পুরোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রন্থাগার একসময় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের উপস্থিতিতে সমৃদ্ধ ছিল। এখন শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে গেছে, শিক্ষকও কম যান। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রন্থাগারেও উপস্থিতি অনেকটাই নামমাত্র। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষিতদের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠা কঠিন।
একটি সত্য হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে দেশ জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা, উদ্ভাবন, এমনকি উন্নত রাষ্ট্র গঠনেও পিছিয়ে পড়ে। বাংলাদেশ ৫৫ বছরেও জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারেনি, যা পাঠবিমুখতার কারণে সম্ভব হয়েছে। পাঠ ও অধ্যয়নের মাধ্যমে গড়ে ওঠা শিক্ষিত ও মেধাবী মানুষ দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকলে সমাজের চেহারা আজ এতটা কদর্য হতো না।
অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ নিরক্ষর বা স্বল্প অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হলেও নতুন কিছু জানার আগ্রহ ও কৌতূহল রয়েছে। আধুনিক কৃষি উৎপাদনের প্রতি তাদের আগ্রহ ও সৃষ্টিশীল চিন্তার কারণে সাড়ে পাঁচ দশকের মধ্যে বাংলাদেশের খাদ্যোৎপাদন প্রায় চারগুণ বেড়ে ৫০০ লাখ টন ছাড়িয়েছে। কিন্তু মানহীন শিক্ষাব্যবস্থা সনদধারীদের মধ্যে আগ্রহ বা কৌতূহল তৈরি করতে পারেনি। তারা মৌলিক চিন্তাভাবনা ও সৃষ্টিশীলতা হারিয়েছে। ফলে তারা বই পড়তে আগ্রহী নয়, বরং নিন্দা, পরচর্চা, রটনা, সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রবাদিতা পছন্দ করে।
পারিবারিক সংস্কৃতিও পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার পক্ষে নয়। পরিবারের আলোচনায় রাজনীতি, কেনাকাটা, বিদেশ ভ্রমণ, ধনীদের জীবন, টিভি ধারাবাহিক ইত্যাদি থাকে, কিন্তু বই নয়। নাগরিক সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠরা কখনো কনিষ্ঠদের বই পড়ার পরামর্শ দেন, কিন্তু নিজের উদাহরণ দেন না। ফলে বাস্তবে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ গড়ে ওঠে না। গ্রামীণ মানুষকে বই পড়ায় যুক্ত করার সুযোগ রাষ্ট্রই সীমিত রেখেছে।
রাষ্ট্রের এই ভূমিকা শিক্ষিত ও পাঠানুরাগী মানুষ গড়ে তোলার পথে বাধা দিয়েছে এবং জ্ঞানবিমুখ উগ্রপন্থী লুটেরাদের সুবিধা দিয়েছে। তারা নারীর শিক্ষা ও পাঠাভ্যাসকেও ভয় পায়। কারণ শিক্ষিত নারী জ্ঞানী মা হিসেবে সন্তানকে শিক্ষিত ও পাঠানুরাগী করবে, যা রাষ্ট্র ও সমাজের কদর্যতা ও পশ্চাৎমুখী চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করবে।
বাংলাদেশে বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে হলে এমন রাষ্ট্রব্যবস্থা দরকার, যা প্রতিটি মানুষের জন্য খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ও চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণযুক্ত মানসম্মত শিক্ষা গড়ে তুলবে সমতাপূর্ণ উন্নত রাষ্ট্র এবং জ্ঞানমনস্ক সমাজ।
● লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক
* মতামত লেখকের নিজস্ব

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন