মামলায় থমকে গেছে এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচন প্রক্রিয়া
| এফবিসিসিআই | 
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এক বছরের বেশি সময় ধরে নেতৃত্বশূন্য আছে। ভোটে নির্বাচিত নেতৃত্বের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের জন্য সরকার একটি প্রশাসক নিয়োগ করেছিলেন। তবে ওই প্রশাসকও নিজ উদ্যোগে নির্বাচন করতে পারেননি এবং তার মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। দেড় মাস শূন্য থাকার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নতুন একজন অতিরিক্ত সচিবকে এফবিসিসিআইয়ে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। তবে তিনি এখনো দায়িত্ব নেননি।
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ, চাঁদার হার কমানো, মনোনীত পরিচালক নির্বাচন প্রক্রিয়া ও নির্বাচন বোর্ড গঠনের সমস্যার কারণে একাধিক ব্যবসায়ী উচ্চ আদালতে রিট মামলা করেছেন। চারটি রিট মামলার কারণে এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচন দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে পড়ে। দুই দফায় নির্বাচন বোর্ড পুনর্গঠন করেও নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। সাবেক অনেক নেতা জানিয়েছেন, সংগঠনটির নির্বাচন প্রক্রিয়া এখন ঝুলে আছে।
বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা না সংশোধন হলে এই অচলাবস্থা কাটবে না। নতুন প্রশাসক নিয়োগেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। দীর্ঘদিন নেতৃত্ব না থাকার কারণে সাধারণ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার কোনো জায়গা নেই। দেড় মাস ধরে প্রশাসক পদ শূন্য থাকায় ফেডারেশনের মতিঝিল কার্যালয়ে ব্যবসায়ীদের আনাগোনা কমে গেছে।
নির্বাচন কবে হবে তা অনিশ্চিত থাকলেও এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কয়েকজন ব্যবসায়ী প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ, সাবেক সহসভাপতি মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ, সাবেক প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী, সাবেক পরিচালক মো. পারভেজ সাজ্জাদ আক্তার, বাংলাদেশ সিএনজি যন্ত্রপাতি আমদানিকারক সমিতির সভাপতি জাকির হোসেন প্রমুখ।
গত বছরের আগস্টে দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর এফবিসিসিআইয়ে সরকার নিযুক্ত প্রশাসক দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেশনের সাবেক নেতাদের সমন্বয়ে একটি সহায়ক কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটির সদস্য আবুল কাশেম হায়দার বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ব্যর্থতার কারণে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালায় অপ্রয়োজনীয় অনেক বিষয় সংযোজন করা হয়েছে, যা পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। তিনি বলেন, এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে বিধিমালাটি সঠিকভাবে সংশোধন করে নির্বাচনের জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিবেশ বদলালে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) পরিচালনা পর্ষদের পদত্যাগের দাবিতে সদস্যদের একাংশ তৎপর হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সভাপতি মাহবুবুল আলম পদত্যাগ করেন। পরে ১১ সেপ্টেম্বর ফেডারেশনের পর্ষদ বাতিল করে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য মো. হাফিজুর রহমানকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাঁকে ১২০ দিনের মধ্যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করে নির্বাচিত পর্ষদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বলা হয়।
এফবিসিসিআইয়ের সাধারণ পরিষদের সদস্যরা—যাঁরা পর্ষদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন—পরে এফবিসিসিআইয়ের বৈষম্যবিরোধী সংস্কার পরিষদ গঠন করেন। তারা মনোনীত পরিচালক প্রথা বাতিল, পর্ষদের সদস্যসংখ্যা কমানোসহ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাব দেন। অক্টোবরে বিভিন্ন চেম্বার ও পণ্যভিত্তিক ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ১২টি সংস্কার প্রস্তাব পাঠান প্রশাসককে। এরপর গত মে মাসে বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা চূড়ান্ত করা হয়। ততদিনে প্রশাসকের আট মাস মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
নতুন বিধিমালা জারি হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচনী বোর্ড গঠন করে। ১৮ জুন তফসিল ঘোষণা করা হয়। তাতে বলা হয়, ৭ সেপ্টেম্বর সরাসরি ভোটে সভাপতি, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, ২ জন সহসভাপতি এবং ৩০ জন পরিচালক নির্বাচন হবে। পরে ব্যবসায়ী সংগঠনের চাপে নির্বাচনের সময় ৪৫ দিন পিছিয়ে দেওয়া হয়।
এফবিসিসিআইয়ের পরিচালনা পর্ষদে টানা সর্বোচ্চ দুবার দায়িত্ব নেওয়া যাবে। এরপর একবার বিরতি দিয়ে আবার নির্বাচন করা যাবে। এই নিয়ম ভবিষ্যতের পাশাপাশি বিগত সময়ের জন্যও প্রযোজ্য হবে। বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালায় এমন বিধান নির্বাচনের তফসিলেও রাখা হয়েছে। এতে সর্বশেষ দুই পর্ষদে যারা ছিলেন, তাঁদের এবারের নির্বাচনে অংশ নেওয়া কঠিন হয়ে যায়। এই বিধানের কারণে ব্যবসায়ীদের একাংশ ক্ষুব্ধ হন। এরপর থেকে তারা বিধিমালা সংশোধনের দাবিসহ নির্বাচন থামাতে মামলার পথে যান।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্বাচন বোর্ড ও আপিল বোর্ড বেআইনি—এমন অভিযোগে উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করেন ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন আল মাসুম। সাধারণ পরিষদের প্রত্যেক সদস্যের জন্য নিবন্ধন ফি ২ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা বৃদ্ধির কারণে আরেক ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুদ রিট করেন। অতীতে দুবার পর্ষদে থাকা ব্যক্তিদের একবার বিরতি দেওয়ার বিধান চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ। এছাড়া মনোনীত পরিচালক নিয়োগে আইন ও বিধিমালার ভিন্ন প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন ফেডারেশনের সাবেক উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ।
জানা যায়, এফবিসিসিআইয়ের পাশাপাশি ঢাকা চেম্বার, মেট্রোপলিটন চেম্বারসহ বেশ কয়েকটি বাণিজ্য সংগঠনের আপত্তির মুখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। ইতিমধ্যে কী কী সংশোধন করা হবে, সেটিও প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে মন্ত্রণালয়।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে রয়েছেন এবং তাঁদের কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এগিয়ে নিতে হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে ফেডারেশনের নির্বাচন করা প্রয়োজন। তার আগে বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা সংশোধন দরকার। এরপর বাণিজ্য সচিবের অনুরোধে ব্যবসায়ীরা মামলাগুলো তুলে নেবেন।
গত ১০ সেপ্টেম্বর এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক হাফিজুর রহমানের মেয়াদ শেষ হয়। তার পর থেকে ফেডারেশন ভবনে যাননি তিনি। সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নতুন করে অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুর রহিম খানকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। তাঁকেও ১২০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করে নির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বলা হয়েছে। নতুন প্রশাসক আগামী রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নিতে পারেন বলে ফেডারেশনের কর্মকর্তারা জানান।
সদ্য সাবেক প্রশাসক হাফিজুর রহমান বলেন, মামলা চলমান থাকলেও নির্বাচন করার কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। ফলে নতুন প্রশাসক নির্বাচন বোর্ড পুনর্গঠন করে নির্বাচন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা সংশোধনের কাজ এখনও চলমান রয়েছে। 
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন