মবের শিকার রুপলালের মেয়ে নুপুরের বিয়ে
![]() |
| রংপুরে তারাগঞ্জে উন্মত্ত একদল লোকের পিটুনিতে নিহত রূপলাল দাসের মেয়ে নূপুর রানীর বিয়ে আজ। বাড়ির সামনে নতুন পোশাক পরে তাঁর স্ত্রী-সন্তানেরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
রূপলাল রবিদাসের বাড়িতে সকাল থেকেই উৎসবের প্রস্তুতি চলছে। সড়কে রঙিন গেট, উঠানে বাঁশের মাচা, রঙিন কাপড়ের প্যান্ডেল, রান্নার হাঁড়ি থেকে ধোঁয়া উঠছে। বাইরে দেখে মনে হচ্ছে আনন্দঘন অনুষ্ঠান। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, এই উৎসবের পেছনে রয়েছে গভীর শোক। আজ রোববার রূপলালের মেয়ের বিয়ে। ঠিক এই মেয়ের বিয়ের দিন ঠিক করতে যাওয়ার আগের দিন ‘মবের’ হামলায় রূপলাল প্রাণ হারান।
নিহত রূপলালের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামে। পরিবার ও স্থানীয়রা জানান, ১০ আগস্ট রূপলালের বড় মেয়ে নূপুর রানীর বিয়ের দিন ঠিক করার কথা ছিল মিঠাপুকুর উপজেলার শ্যামপুর এলাকার এক তরুণের সঙ্গে। এই কাজের জন্য ৯ আগস্ট প্রদীপ দাস, রূপলালের ভাগনির স্বামী, মিঠাপুকুর থেকে ভ্যান চালিয়ে রূপলালের বাড়ির দিকে রওনা হন।
রাস্তা না চেনায় তিনি সয়ার ইউনিয়নের কাজীরহাট এলাকায় পৌঁছে রূপলালকে ফোন করেন। রূপলাল সেখানে গিয়ে প্রদীপ দাসের সঙ্গে ভ্যানে চড়ে ঘনিরামপুর গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা হন। রাত ৯টার দিকে তারা তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছালে স্থানীয় কয়েকজন তাদের ভ্যানচোর সন্দেহ করে থামিয়ে রাখে। এরপর ধীরে ধীরে সেখানে লোক জড়ো হতে থাকে। একপর্যায়ে মব তৈরি করে রূপলাল ও প্রদীপ দাসকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়।
রূপলালের স্ত্রী এই ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়।
বাবা রূপলালের মৃত্যুর পর নূপুর রানীর বিয়ের আয়োজন বন্ধ হয়ে যায়। রূপলালকে হারিয়ে পুরো পরিবার দিশাহারা হয়ে পড়ে। তবে পরিবারের তথ্য অনুযায়ী, মেয়ের বিয়ের জন্য উপজেলা প্রশাসন এক লাখ, তারাগঞ্জ হাটের ব্যবসায়ীরা ৭১ হাজার, উপজেলা বিএনপির পক্ষ থেকে ৭৫ হাজার এবং একটি সংগঠন এক লাখ টাকা দিয়েছেন। এছাড়া, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন হৃদয়বান ব্যক্তি রূপলালের ছেলে জয় রবিদাস ও ছোট মেয়ে রুপার পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন। তাদের শিক্ষাবৃত্তি সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে এবং এই অর্থে তারা পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
![]() |
| নূপুর রানীর বিয়ে উপলক্ষে বাড়ির সামনের সড়কে রঙিন গেট স্থাপন করা হয়েছে। আজ রোববার সকালে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
রূপলালের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, কনে নূপুর হলুদ রঙের শাড়িতে বসে আছেন। মুখে বিয়ের সাজ, কিন্তু চোখ লাল। পাশে মা ভারতী রানী নীরবে অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী বলেন, 'বেটির বিয়ে ঠিক করার জন্য ভাগনির জামাইকে আনার সময় আমার নির্দোষ স্বামীকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আজ বেটির বিয়ে, কিন্তু তার বাবা নেই, চিন্তাই বুক ভেঙে দিচ্ছে। ওমাক (রূপলাল) ছাড়া পুরো বাড়ি ফাঁকা মনে হচ্ছে। কষ্টে ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছে।'
নূপুর রানী বলেন, 'বাবা চাইতেন ধুমধাম করে আমার বিয়ে হবে। এখন সব আয়োজন হচ্ছে, কিন্তু আমার মনে শুধু বাবার মুখ ভেসে ওঠে। বাবা নেই, কে আমাকে আশীর্বাদ দেবে। যারা বাবাকে মেরেছে, তারা এখনও ধরা পড়েনি, বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে—আমি তাদের বিচার চাই।'
তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবেল রানা বলেন, 'রূপলালের মেয়ের বিয়ের জন্য এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। ছেলে ও ছোট মেয়ের জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে তারাগঞ্জ বাজারে রূপলালের ছেলের জন্য একটি দোকান দেওয়া হবে। আমরা সবসময় তাদের পাশে আছি।'


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন