বাংলাদেশি পর্যটকদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান মালয়েশিয়ার
| গ্রাফিক্স: পদ্মা ট্রিবিউন |
বাংলাদেশি ভ্রমণকারীদের কাছে মালয়েশিয়া ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কিন্তু বৈধ ভিসা থাকা সত্ত্বেও শত শত বাংলাদেশিকে ঢাকা বিমানবন্দরেই আটকে রাখা হচ্ছে বা কুয়ালালামপুরে পৌঁছানোর পর ফেরত পাঠানো হচ্ছে। কারণ, দুই দেশের প্রবেশন কর্তৃপক্ষ এখন আরও কঠোরভাবে যাচাই করছে মালয়েশিয়াকে মধ্যবর্তী পথ হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশিরা অস্ট্রেলিয়ায় অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা করছে কিনা তা রুখতে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশিকে ঢাকা বিমানবন্দরে দেশত্যাগে বাধা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৩ হাজার মালয়েশিয়াগামী পর্যটক ছিলেন বৈধ ভিসাধারী। অন্যদিকে, বাংলাদেশে প্রবেশন কর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়া সত্ত্বেও ঝুঁকি কমেনি অনেকের; জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে ৩,২২৪ বাংলাদেশিকে মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ ফেরত পাঠিয়েছে।
পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) এবং ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের তথ্য ও নথি দেখে জানা গেছে, এসব ফেরত পাঠানোর পেছনে নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। অনেক যাত্রীর বিরুদ্ধে সন্দেহ ছিল যে তারা মালয়েশিয়া হয়ে ইন্দোনেশিয়ার পথ ধরে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
২০২৪ সালের ৭ জুন, অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল পুলিশ ঢাকায় তাদের হাইকমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল দুটি মানবপাচার প্রচেষ্টার কথা—যেখানে ৪১ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পুলিশের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার চাপের কারণে এখন বাংলাদেশি পর্যটকদের যাচাই-বাছাই অনেক কঠোর করা হয়েছে।
মালয়েশিয়ার উপপর্যটনমন্ত্রী খাইরুল ফিরদাউস আকবর খান ৪ নভেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, জানুয়ারি–আগস্টে ২ লাখ ২৯ হাজার ২৯ জন বাংলাদেশি পর্যটক দেশটিতে গেছেন। এটি আগের বছরের তুলনায় ১২৮ শতাংশ বেশি। তবে একই সময়ে ফেরত পাঠানোর সংখ্যাও বেড়েছে, তাই বাংলাদেশের প্রবেশন পুলিশ মালয়েশিয়া হাইকমিশনের কাছে কারণ জানতে চেয়েছে।
গত ১৫–১৬ অক্টোবর এসবির সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে মালয়েশীয় কর্মকর্তারা ২৩টি কারণ তুলে ধরেন, যার ভিত্তিতে বৈধ ভিসাধারীরাও ফেরত পাঠানো হচ্ছে। সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো—ভিসা আবেদনের সময় দেওয়া নথি এবং আগমনের সময় দেখানো নথির মধ্যে মিল না থাকা।
বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তারা জানান, অনেক বাংলাদেশি আবেদনকারী ভিসা পাওয়ার আগে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অনেক টাকা দেখান, কিন্তু ভিসা অনুমোদনের পর তা তুলে নেন। মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষ এটিকে 'ভুয়া পর্যটন ইচ্ছা' হিসেবে দেখছে।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো ভুয়া বা বাতিল করা হোটেল বুকিং। অনেক ভ্রমণকারী ভিসা পাওয়ার পর বুকিং বাতিল করে আত্মীয়দের বাসায় থাকার চেষ্টা করেন। কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরের প্রবেশন কর্মকর্তারা এসব অসঙ্গতি ধরতে পারেন, যখন ভ্রমণকারী আবেদনকৃত হোটেল বা সংরক্ষণ প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হন, যা তারা ভিসা আবেদনের সময় দেখিয়েছিলেন।
ঢাকা বিমানবন্দরের একজন প্রবেশন কর্মকর্তা বলেন, অনেক যাত্রীর কাছে পর্যাপ্ত অর্থও থাকে না। 'কেউ কেউ বলেন ঘুরতে যাচ্ছেন, কিন্তু সঙ্গে ১০০ ডলারও নেই,' বলেছেন ওই কর্মকর্তা।
অন্যদিকে, মালয়েশিয়ায় বেড়ে যাওয়া অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা যাদের বৈধতা পেতে ৬ হাজার রিঙ্গিত পর্যন্ত খরচ হয় তার মধ্যে কেউ কেউ পাচারকারীদের মাধ্যমে সমুদ্রপথে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন।
সিআইডির মানবপাচার প্রতিরোধ শাখা অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশি, মালয়েশীয় ও ইন্দোনেশীয় পাচারচক্র টিকটক ও ফেসবুক ব্যবহার করে প্রবাসীদের ফাঁদে ফেলছে। তারা প্রায় ৬ লাখ টাকার বিনিময়ে অস্ট্রেলিয়ায় নৌকাযোগে পাঠানোর প্রলোভন দেখাচ্ছে।
সিআইডি ইতোমধ্যেই কয়েকটি টিকটক অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করেছে। এগুলো হলো– অস্ট্রেলিয়া বয় ৭৭০, হাসানমোহাম্মদ ১৩১২, অস্ট্রেলিয়া.সিডনি ৪০, মো. রকিব.রহমান এবং খান অস্ট্রেলিয়া জিসান খান।
ইন্দোনেশিয়ার জলসীমা দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টার সময় ২০২৩ ও ২০২৪ সালে অস্ট্রেলীয় উপকূলরক্ষী বাহিনী অন্তত ৪১ জন বাংলাদেশিকে আটক করেছে।
সিআইডির অতিরিক্ত সুপারিনটেনডেন্ট মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করেছি, যেগুলো (অস্ট্রেলিয়ায়) কাজ ও নাগরিকত্ব পাওয়ার ভুয়া প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এটা পুরোপুরি প্রতারণা, এবং একটি বড় সতর্ক সংকেত।'
তদন্তে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় থাকা বাংলাদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে পাচারকারীরা প্রথমে অনলাইনে যোগাযোগ করে। বলা হয়, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পা রাখার পরই টাকা দিতে হবে।
যাত্রা শুরু হয় মালয়েশিয়ার জোহর বাহরু থেকে। সেখান থেকে ছোট নৌকায় তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ইন্দোনেশিয়ার কুপাং দ্বীপে। সেখানে পৌঁছে তাদের জিম্মি করে ৬ লাখ টাকা আগাম দিতে বাধ্য করা হয়, এরপর গন্তব্য হয় অস্ট্রেলিয়ার ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ক্রিসমাস আইল্যান্ড।
বেশিরভাগের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছানোর স্বপ্ন এখানেই শেষ হয়। কারণ, অনেককে ক্রিসমাস আইল্যান্ডের কাছে আটক করা হয় এবং পরে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী, ২০২৩ সালে অন্তত ৮ জন এবং ২০২৪ সালে আরও ৩২ জন বাংলাদেশি এভাবে আটক হয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক কেটিএম কনসাল্টিং গ্রুপের আহম্মেদ হোসেন জিবু বলেন, 'সমুদ্রপথে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছাতে যারা পাচারকারীদের টাকা দিচ্ছেন, তারা মূলত প্রতারণার শিকার। শেষমেষ তারা আটক ও দেশে ফেরত পাঠানো হয়, এতে বাংলাদেশের পাসপোর্টের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়।'
যোগাযোগ করা হলে এক লিখিত জবাবে ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশন জানায়, 'অস্ট্রেলিয়া মানবপাচার রোধে বাংলাদেশের মতো আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। প্রতিটি ভিসা আবেদনই ব্যক্তির যোগ্যতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়।'
ইমিগ্রেশন পুলিশের তথ্যমতে, মালয়েশিয়ায় প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসী থাকেন। এর মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশের বৈধ ভিসা নেই বা ব্যবসা চালানোর জন্য তাদের ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন।
সিআইডির অতিরিক্ত এসপি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'অনেকে ভালো কাজ এবং উন্নত জীবনের আশায় অস্ট্রেলিয়ায় যেতে চাইছেন। কিন্তু বাস্তবে এটি এক ধরনের মরীচিকা ছাড়া আর কিছু নয়।'
Comments
Comments