চট্টগ্রামে পানগাঁও ও লালদিয়া টার্মিনালও পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছে বিদেশিরা
![]() |
| চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়ার চরের এই স্থানে নির্মাণ করা হবে কনটেইনার টার্মিনাল | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব ৩৩ বছরের জন্য বিদেশিদের হাতে দেওয়া হচ্ছে। দায়িত্বটি পাচ্ছে ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালস। আগামী সপ্তাহে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার চুক্তি হবে।
গতকাল বুধবার অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভায় এই প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। চুক্তির মেয়াদ আরও ১৫ বছর বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও এপিএম টার্মিনালসের মধ্যে চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে।
লালদিয়া ছাড়াও ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান মেডলগ এসএর হাতে দেওয়া হচ্ছে, শুধু সরকারি অনুমোদনের অপেক্ষা। চালু থাকা টার্মিনালও হস্তান্তরের চুক্তি হবে। এতে বন্দরের দুইটি টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরের হাতে চলে যাচ্ছে।
নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বা এনসিটি পরিচালনায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে দর-কষাকষি শুরু হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে এই টার্মিনালও বিদেশিদের হাতে দেওয়া হবে। এছাড়া বে টার্মিনালের দুটি টার্মিনালও বিদেশিদের হাতে দেওয়া হচ্ছে। বন্দরের চিটাগং কনটেইনার টার্মিনালেও (সিসিটি) বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে বিদেশিরা। সব দেওয়া হলে বন্দরের হাতে শুধু জেনারেল কার্গো বার্থ বা জিসিবি থাকবে।
বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তির আগে বন্দরে মিছিল, সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও এক মাস বাড়িয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ। মঙ্গলবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা থাকবে।
বিদেশিদের হাতে একের পর এক টার্মিনাল দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে বছরের শুরু থেকে বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলন করছে। এনসিটি ছেড়ে দেওয়ার আগে বন্দর জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল মাঠে আসে। এরপর পেশাজীবী ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও আপত্তি জানায়। চট্টগ্রাম পোর্ট ইউজার্স ফোরামও মাশুল বাড়ানোর অভিযোগ তুলে কর্মসূচি পালন করেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক সদস্য জাফর আলম বলেন, ‘লালদিয়া টার্মিনালে কোনো অবকাঠামো নেই, তাই টার্মিনাল নির্মাণে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। গ্রিনফিল্ড প্রকল্প বিদেশি অপারেটরের হাতে দেওয়া ভালো সিদ্ধান্ত। তবে নিউমুরিংসহ চালু টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরের হাতে দেওয়ার সময় চিন্তাভাবনা করা উচিত।’
এর বাইরে বন্দরের চিটাগং কনটেইনার টার্মিনালেও (সিসিটি) বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে বিদেশিরা। এটিও যদি বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে বন্দরের হাতে থাকবে শুধু একটি টার্মিনাল, জেনারেল কার্গো বার্থ বা জিসিবি।
লালদিয়া টার্মিনাল চুক্তিতে যা থাকছে
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) আওতায় জি টু জি ভিত্তিতে লালদিয়া টার্মিনাল ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালসকে দেওয়া হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের পক্ষে মধ্যস্থতা করছে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। তাদের মধ্যস্থতায় এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে বন্দরের প্রায় এক মাস ধরে চলা দর-কষাকষি গত সোমবার শেষ হয়েছে।
দর-কষাকষির পর এখন যা ঠিক হয়েছে, তাতে মূল কনসেশন চুক্তির মেয়াদ ৩৩ বছর। টার্মিনাল নির্মাণে প্রায় তিন বছর সময় লাগতে পারে। শর্তপূরণ সাপেক্ষে চুক্তির মেয়াদ আরও ১৫ বছর বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। ফলে মোট ৪৮ বছরের জন্য লালদিয়া চরটি এপিএম টার্মিনালসের হাতে থাকবে। প্রতিষ্ঠানটি পতেঙ্গার লালদিয়ার চরটিতে টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা করবে। টার্মিনালের তিনটি জেটিতে বছরে আট লাখ কনটেইনার ওঠানো-নামানোর ক্ষমতা থাকবে। নির্মাণে ৬০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে এপিএম টার্মিনালস।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল কেন্দ্রিক যে সব সেবা দেওয়া হবে, সেগুলোর বিপরীতে মাশুল আদায় করবে এপিএম টার্মিনালস। বিদেশি অপারেটর যা আদায় করবে, তার একটি অংশ বন্দরকে দেওয়া হবে, তবে এর পরিমাণ এখনও প্রকাশ করেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। এছাড়া বন্দর কর্তৃপক্ষ বিদেশি অপারেটর থেকে এককালীন অর্থও পাবে।
টার্মিনালের তিনটি জেটিতে বছরে আট লাখ কনটেইনার ওঠানো-নামানোর সক্ষমতা থাকবে। টার্মিনালটি নির্মাণে ৬০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে এপিএম টার্মিনালস।
লালদিয়া টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে গতকাল ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখানে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশিক চৌধুরী বলেন, এপিএম টার্মিনালস এই প্রকল্পের নকশা, অর্থায়ন, নির্মাণ ও পরিচালনা করবে। তবে বন্দরটির মালিকানা চট্টগ্রাম বন্দরের হাতে থাকবে। চুক্তির আওতায় এপিএম টার্মিনালস পুরো মেয়াদে ৮০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। এটি চালু হলে বন্দরের কনটেইনার ওঠানো-নামানোর ক্ষমতা আট লাখ একক বাড়বে।
আশিক চৌধুরী আরও জানান, প্রকল্পের কাজ আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে শুরু হতে পারে। সরকার টার্মিনালটি ২০২৯ সালের মধ্যে চালুর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। নির্মাণের পর ৩০ বছর এপিএম টার্মিনালস এটি পরিচালনা করবে।
লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল আগের আওয়ামী লীগ সরকারের সময়। প্রথমে ২০২১ সালের জুনে ডেনমার্ক সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের জি টু জি সমঝোতা হয়। এরপর ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে দুই দেশের যৌথ সভায় লালদিয়া প্রকল্প বাছাই করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর প্রকল্পটি দ্রুত এগোতে শুরু করে।
এপিএম টার্মিনালস ডেনমার্কভিত্তিক বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিপিং কোম্পানি মায়ের্সক লাইনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এপিএম টার্মিনালসের সদর দপ্তর নেদারল্যান্ডসের হেগে। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তারা বিশ্বের ৩৩টি দেশে ৬০টি টার্মিনাল ও বন্দর পরিচালনা করছে। এই প্রকল্পে স্থানীয় অংশীদার হিসেবে রয়েছে কিউএনএস কনটেইনার সার্ভিসেস।
বন্দর বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার যেসব দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি হচ্ছে, তা করার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। কারণ, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি জড়িত। এসব চুক্তি করার জন্য গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণ এই সরকারকে ক্ষমতায় বসায়নি।
— গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ
পানগাঁও নৌ টার্মিনাল ২২ বছরের জন্য বিদেশিদের হাতে
কেরানীগঞ্জে অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দরের পানগাঁও নৌ টার্মিনালটি ২২ বছরের জন্য সুইজারল্যান্ডের মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানি মেডলগ এসএ পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছে। বন্দরের সব প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করেছে।
টার্মিনালটি পরিচালনার জন্য মেডলগ এসএ প্রথমে ১০৮ কোটি টাকা আর্থিক প্রস্তাব দিয়েছিল। দর-কষাকষির পর এটি চূড়ান্তভাবে ১২১ কোটি টাকায় ঠিক হয়। এখন সরকারি অনুমোদনের পর প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে ২০১৩ সালে ১৫৬ কোটি টাকায় এই টার্মিনাল গড়ে তুলেছিল।
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, 'বন্দর বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। কারণ, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণ এই সরকারকে ক্ষমতায় বসায়নি, তাই এই চুক্তি করার অধিকার নেই।'

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন