১০ মাসে ৭৫৬টি রাজনৈতিক সংঘাতে ১১৭ জন নিহত
| এইচআরএসএস |
চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে দেশে অন্তত ৭৫৬টি রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১১৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৬ হাজার ৯২ জন। সংঘর্ষের কারণ হিসেবে প্রধানত উল্লেখ করা হয়েছে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার, প্রতিশোধপরায়ণতা, সমাবেশ ঘিরে সহিংসতা, কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধ, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন স্থাপনা দখল।
নিহতদের মধ্যে বিএনপির ৮০ জন, আওয়ামী লীগের ২৩ জন, জামায়াতের ৩ জন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ১ জন, ইউপিডিএফের ৬ জন এবং চরমপন্থী দলের ১ জন। বাকি ৩ জনের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি।
আজ বুধবার ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি জানুয়ারি-অক্টোবর ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)। প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে দেশের ১৫টি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ এবং সংগঠনটির তথ্য অনুসন্ধানী ইউনিটের তথ্যের ভিত্তিতে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭৫৬টি সংঘর্ষের মধ্যে ৪৩২টি হয়েছে বিএনপি ও তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অন্তঃকোন্দলের কারণে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭০ জন এবং আহত অন্তত ৪ হাজার ৬৫ জন। আওয়ামী লীগের ১৩টি অন্তঃকোন্দলে নিহত হয়েছেন ৭ জন এবং আহত ১৫৩ জন। এর বাইরে এনসিপির ১৪টি অন্তঃকোন্দলে ৪৫ জন আহত হয়েছেন। জাতীয় পার্টি ও গণ অধিকার পরিষদের মধ্যে ৪টি সংঘর্ষে ৩৩ জন আহত হয়েছেন। পুলিশ ও গণ অধিকার পরিষদের সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হয়েছেন।
দুই প্রধান দলের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা নিয়েও প্রতিবেদনটি বিস্তারিত জানিয়েছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ১৩২টি সংঘর্ষে ১৯ জন নিহত ও ৬৮৪ জন আহত হয়েছেন। বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে ৪৯টি সংঘর্ষে ২ জন নিহত এবং ৪৬২ জন আহত হয়েছেন। বিএনপি-এনসিপির মধ্যে ১৬টি সংঘর্ষে ১৩৪ জন আহত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ-এনসিপির ২০টি সংঘর্ষে ১ জন নিহত এবং ৫৬ জন আহত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের ৮টি সংঘর্ষে ২ জন নিহত এবং ১০ জন আহত হয়েছেন।
এই সময়ে সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীদের হামলায় রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের ওপর ১২৮টি ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ৮৯ জন নিহত এবং ১৫০ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৯ জন, বিএনপির ৪৭ জন, জামায়াতের ৪ জন এবং বাকিরা অন্যান্য দলের।
এই বিষয়ে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, 'গত ১০ মাসে দেশে গুম বা ক্রসফায়ারের মতো ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। পরিস্থিতির উন্নয়নের আশা থাকলেও মানবাধিকার লঙ্ঘন আগের মতোই চলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও আশা করা উন্নতি হয়নি।'
মব ও গণপিটুনিতে ১৪০ জনের মৃত্যু
মব সহিংসতা ও গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক উল্লেখ করে মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১০ মাসে মব সহিংসতা ও গণপিটুনির অন্তত ২৫৬টি ঘটনায় ১৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ২৩১ জন। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারীরা এই সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
এ ছাড়া এ সময়ে কারাগারে অন্তত ৬৮ জন আসামি মারা যান। তঁদের মধ্যে ২২ জন কয়েদি ও ৪৬ জন হাজতি।
সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতন
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১০ মাসে অন্তত ২৭০টি হামলায় অন্তত ৩৮৪ জন সাংবাদিক নির্যাতন, হত্যা ও হয়রানির শিকার হন। এ সময়ে ২ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া অন্তত ২৩৪ জন আহত, ৪৭ জন লাঞ্ছিত, ৬৩ জন হুমকির শিকার ও ১৩ জন সাংবাদিক গ্রেপ্তার হন। পাশাপাশি ২৯টি মামলায় ১০৩ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই সময়ে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩–এর অধীনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১ জনকে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ১০ জন নিহত
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে চলতি বছরে ১০ জন নিহত হয়েছেন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১০ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংষর্ষে, হেফাজতে ও নির্যাতনে কমপক্ষে ২৯ জন নিহত হয়েছেন। যাঁদের মধ্যে ৮ জন বন্দুকযুদ্ধে, ৪ জন নির্যাতনে, ১০ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে এবং ৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
এ ছাড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে ২৩ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। আর ৩৪ জন আহত ও ৬০ জন গ্রেপ্তার হন। এই সময়ে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ৩ হাজার ৩৯৯ জনকে বাংলাদেশে পুশ ইন করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মির পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে আনসার সদস্যসহ ১২ জন আহত এবং ১ জন নিহত হন।
বিশেষ অভিযানে প্রায় ৫০ হাজার গ্রেপ্তার
১০ মাসে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের নামে ১৯০টি মামলা হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়ে বিভিন্ন মামলায় যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযানে অন্তত ৪৯ হাজার ২৪৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাঁদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা–কর্মী। গত ১০ মাসে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের অন্তত ৪৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পারিবারিক সহিংসতায় নিহত ৩২৩ জন
গত ১০ মাসে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় নিহত ২৮ জন ও আহত হয়েছেন ২৬ জন। আত্মহত্যা করেছেন ৪ নারী। পারিবারিক সহিংসতায় নিহত ৩২৩ জন, আহত হয়েছেন ৮৩ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১৪৯ নারী। অ্যাসিড–সহিংসতার শিকার হয়ে ২ জন নিহত হয়েছেন।
ধর্ষণের শিকার ৭৪১ জন নারী
এই সময়ে ১ হাজার ৭৩২ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় ৭৪১ জন, যাদের মধ্যে ৪৩০ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু; যা মোট সংখ্যার ৫৮ শতাংশ। ১৬১ জন নারী ও কন্যাশিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৪ জনকে ও আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন নারী।
এ ছাড়া এই সময়ে ২১১টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় ৮৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৯৪৪ জন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং শ্রমিকদের সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাবে দুর্ঘটনায় ১৪০ জন শ্রমিক মারা গেছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ২৪টি হামলার ঘটনায় ১৫ জন আহত হয়েছেন। পাশাপাশি ৫টি মন্দির, ৩৭টি প্রতিমা ও ৩৮টি বসতবাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। আর ৫০টির বেশি মাজারে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
Comments
Comments