সংগঠিত ছাত্রশিবিরের সামনে অগোছালো ছাত্রদল
![]() |
| চাকসু নির্বাচনে ভোট দিতে সারিতে শিক্ষার্থীরা। গত বুধবার দুপুরে ব্যবসায় অনুষদ ভবনে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
দুই বছর আগেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ ছিল না জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের। কিন্তু গত এক বছরে পরিস্থিতি বদলেছে। এই সময়টিতে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছে ছাত্রশিবির। অন্যদিকে ছাত্রদল সংগঠন গোছাতে পারেনি। আর সেই অগোছালো অবস্থার খেসারত দিতে হয়েছে এবারের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে।
ছাত্রশিবির গত এক বছরে ক্যাম্পাসে নিজের শৃঙ্খলা ও সুসংগঠিত কাঠামো গড়ে তুলেছে। নিয়মিত সভা-সমাবেশ, সাংস্কৃতিক আয়োজন, অনলাইন ক্যাম্পেইন—সবকিছুতেই তারা দেখিয়েছে সংগঠিত উপস্থিতি। ফলে নির্বাচনের ময়দানে তারা প্রস্তুত ছিল, ছাত্রদল ছিল এলোমেলো।
গত বুধবার অনুষ্ঠিত সপ্তম চাকসু নির্বাচনে ২৬টির মধ্যে ২৪টি পদে জয়ী হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’। শীর্ষ দুই পদ—সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস)—উভয়ই পেয়েছেন শিবির-সমর্থিত প্রার্থীরা। তবে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে জয় পেয়েছেন ছাত্রদলের আইয়ুবুর রহমান।
নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ২৭ হাজার ৫১৬ জন। ভোট পড়েছে ৬৫ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ১৭ হাজার ৮৮৫ জন ভোট দিয়েছেন। চাকসু নির্বাচন এখন পর্যন্ত সাতবার হয়েছে। ১৯৮১ সালের নির্বাচনে ছাত্রশিবির প্রথম জয় পায়। এরপর ১৯৯০ সালে হেরে যায় তারা। ফলে ৪৪ বছর পর আবার চাকসুর নেতৃত্বে ফিরল ছাত্রশিবির।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের কমিটি মাত্র ৫ সদস্যের, যা দুই বছর আগে ২০২৩ সালের ১১ আগস্ট ঘোষণা করা হয়। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এই কমিটির মেয়াদ শেষ। কমিটির নেতারা হলেন কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলাউদ্দিন মহসিন, সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি (বর্তমানে বহিষ্কৃত) মোহাম্মদ মামুন উর রশিদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. ইয়াসিন ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন। এ পাঁচজনের কারও নিয়মিত ছাত্রত্ব নেই।
নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ২৭ হাজার ৫১৬ জন। ভোট পড়েছে ৬৫ শতাংশ। সে হিসাবে ভোট দিয়েছেন প্রায় ১৭ হাজার ৮৮৫ জন। এখন পর্যন্ত চাকসু নির্বাচন হয়েছে সাতবার। ১৯৮১ সালের নির্বাচনে ছাত্রশিবির পেয়েছিল প্রথম জয়। এরপর ১৯৯০ সালে হেরে যায় তারা। ফলে ৪৪ বছর পর আবার চাকসুর নেতৃত্বে ফিরল ছাত্রশিবির।
দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল। এমনকি বিএনপি সরকারের সময়েও (২০০১-০৬) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাদের প্রভাব ছিল সীমিত। তখন শিবিরের প্রভাব প্রবল ছিল, পরে আসে ছাত্রলীগের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। গত বছরের ৫ আগস্টের পর ক্যাম্পাসে উন্মুক্ত পরিবেশ ফিরে এসেছে, কিন্তু ছাত্রদল তা কাজে লাগাতে পারেনি। ফলে কোনো শক্ত অবস্থান তৈরি হয়নি। এমনকি প্রার্থী বাছাইয়েও দেখা গেছে মতবিরোধ ও অমিল।
প্রাথমিক বিশ্লেষণে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা অন্তত পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করেছেন—প্রস্তুতির অভাব, সংগঠনের বিভাজন, প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে বিরোধ, সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং যোগাযোগহীনতা। অভ্যন্তরীণ কোন্দল নির্বাচনের প্রস্তুতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ক্যাম্পাসে ছাত্রদল কার্যত বিভক্ত। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা অন্তত তিন ভাগে বিভক্ত। চাকসু নির্বাচনে তারা এক হতে পারেনি। উদাহরণ হিসেবে, ছাত্রদলের ৫ সদস্যের কমিটিতে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ মামুন উর রশিদ ছাত্রদল-মনোনীত প্যানেলের বাইরের এক প্রার্থীকে সমর্থন করেছিলেন। এ ঘটনার পর তাঁকে আজীবনের জন্য সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন। গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সংগঠন ঠিকভাবে গঠন করতে পারিনি। এখন আমাদের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে কমিটি ঘোষণা করা হবে।’
![]() |
| চাকসুতে বিজয়ী ছাত্রশিবির সমর্থিত সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মো. ইব্রাহিম হোসেন (বাঁয়ে) ও জিএস সাঈদ বিন হাবিব | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রভাব চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নয়। আশির দশক থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তারা সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেছে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর প্রায় এক দশক আত্মগোপনে থাকে সংগঠনটি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ কমে গেলে সেই শূন্যস্থানে আবার সংগঠিত হয় ছাত্রশিবির। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশ্যে আসেন তাদের সভাপতি ও সেক্রেটারি। পরে অক্টোবর মাসে প্রকাশ্যে আসেন সাহিত্য সম্পাদক সাঈদ বিন হাবিব, যিনি এবার নির্বাচনে জিএস পদে জয়ী হয়েছেন।
নির্বাচনে একচেটিয়া জয়ের বিষয়ে সাঈদ বিন হাবিব বলেন, ‘এই নির্বাচনের জন্য আমাদের এক বছরের পরিকল্পনা ছিল। গত এক বছরে ৮ শতাধিক কর্মসূচি পালন করেছি। এর মধ্যে নবীনবরণ, বিতর্ক, আন্তর্জাতিক সেমিনার, গণ-ইফতার, কৃতী সংবর্ধনা সহ নানা কর্মসূচি ছিল। সবকিছুই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার অংশ ছিল।’
শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিবিরের ৪৪ বছর পর পাওয়া এই জয় শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি ক্যাম্পাসের ভবিষ্যৎ রাজনীতির দিকনির্দেশকও। অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোস্তফা গালিব বলেন, ছাত্রদল শুরু থেকেই প্রচারণায় পিছিয়ে ছিল। অনলাইনে তারা শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি। ভিপি, জিএস ও এজিএস প্রার্থী ছাড়া বাকিরা বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছাতে পারেননি। ছাত্রশিবিরের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা চোখে পড়েনি।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন