হাসপাতালের বিছানায় নুরুল মজিদের হাতকড়া নিয়ে বিতর্ক
‘কিন্তু মানুষের সেই প্রত্যাশা চরম হতাশায় পরিণত হয়েছে।’সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের দুটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়েরের ফেসবুকে দেওয়া ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তিনি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন এবং হাতে হাতকড়া পরা। চোখ বন্ধ।
কেউ বলছেন, মুমূর্ষু অবস্থায়ও নূরুল মজিদের হাতে হাতকড়া ছিল। কেউ বলছেন, মৃত্যুর পরও তাকে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছিল। অনেকে এটিকে অমানবিক বলছেন এবং মন্তব্য করেছেন যে, প্রতিহিংসার রাজনীতি এখনও রয়ে গেছে।
ছবিটি কখন তোলা হয়েছিল তা জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও উন্নয়ন) জান্নাত-উল-ফরহাদ বলেন, 'গত সেপ্টেম্বরে ছয় দফা নূরুল মজিদকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। ছবিটি ওই সময়ের কোনো এক দিনে হতে পারে।' তিনি বলেন, 'নিয়ম অনুযায়ী নিরাপত্তার স্বার্থে চিকিৎসার সময় বন্দীর হাতে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়। বা হাতকড়া কোনো কারারক্ষীকে ধরে রাখতে হয়। হাতকড়া খুলে দেওয়ার সুযোগ সাধারণত নেই।'
পুলিশ প্রবিধানের ৩৩০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বা তদন্তস্থলে পাঠানোর সময় পুলিশকে বন্দীকে পালানো রোধ করার জন্য যা প্রয়োজন তার বেশি কড়াকড়ি করা উচিত নয়। হাতকড়া বা দড়ির ব্যবহার প্রায় সব ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ও অমর্যাদাকর। বয়স বা দুর্বলতার কারণে যাদের নিরাপত্তা সহজে রাখা যায়, তাদের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করা উচিত নয়।
নূরুল মজিদকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালত সূত্র জানিয়েছে, তাঁর নামে ঢাকায় চারটি হত্যা মামলা এবং নরসিংদীতে একটি হত্যা মামলা রয়েছে। তিনি কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় সোমবার সকালে তিনি মারা যান। বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক সুরাইয়া আক্তার বলেন, 'সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো ছবিটি মৃত্যুর আগের।'
সুরাইয়া আক্তার আরও বলেন, 'কারা কর্তৃপক্ষ নূরুল মজিদের চিকিৎসায় কোনো অবহেলা করেনি। প্রায় এক মাস আগে তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। পরে বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করা হয়। সুস্থ হলে আবার কারা হাসপাতালে ফিরানো হয়। কিছুটা অসুস্থ বোধ করার কারণে তাঁকে পুনরায় বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু আইসিইউতে খালি সিট না থাকায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।'
কারা ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, নূরুল মজিদের হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ নানা সমস্যা ছিল। সর্বশেষ তিনি ডায়রিয়া ও সংশ্লিষ্ট জটিলতায় আক্রান্ত ছিলেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, 'জরুরি চিকিৎসার জন্য নূরুল মজিদকে বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি থেকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার করা হয়। মেডিসিন বিভাগের প্রধান তাঁর চিকিৎসা করেছেন। তাঁকে যথাসময়ে কেবিন দেওয়া হয় এবং পরে আইসিইউতে নেওয়া হয়। চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ সঠিক নয়।'
নূরুল মজিদ নরসিংদী-৪ (মনোহরদী-বেলাব) আসনের পাঁচবারের সাবেক সংসদ সদস্য। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন।
নূরুল মজিদের মরদেহ মঙ্গলবার নরসিংদীতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে সোমবার এশার নামাজের পর রাজধানীর গুলশান এলাকার আজাদ মসজিদে এবং মঙ্গলবার মনোহরদী উপজেলার শুকুর মাহমুদ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
নূরুল মজিদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলে মঞ্জুরুল মজিদ মাহমুদ যুবলীগের রাজনীতি করছেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। স্থানীয় সূত্রের দাবি, তিনি বিদেশে চলে গেছেন।
নূরুল মজিদের আইনজীবী দিলরুবা কলি বলেন, 'তিনি বয়স্ক ছিলেন, কিন্তু গ্রেপ্তারের সময় সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। শারীরিক কোনো জটিলতা ছিল না।' তিনি আরও বলেন, 'মাস পাঁচেক আগে নরসিংদীতে আমি নিজেই তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছিলেন, আমি সুস্থ আছি। তোমরা আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না।'
দিলরুবা আরও বলেন, 'নূরুল মজিদের ডেঙ্গু হয়েছিল এবং তাঁর সুচিকিৎসা হয়নি।'
বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।মঙ্গলবার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘ফেসবুকে আমি হুমায়ুনের লাশের ছবি দেখলাম। হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো। পাশে দাঁড়িয়ে দুজন আনসার গল্প করছে। খুব কস্ট পেলাম, লাশের হাতে হ্যান্ডকাফ! এ কেমন অমানবিকতা!’
নূরুল মজিদের সঙ্গে নিজের প্রসঙ্গ তুলে ধরে মাহমুদুর রহমান মান্না আরও বলেন, ‘হুমায়ূন ৬৬-৬৮-তে ঢাকা কলেজে আমার সহপাঠী ছিলেন। তখন তার সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল না। পরবর্তীতে রাজনীতি (আওয়ামী লীগ) করতে এসে তার সঙ্গে সখ্যতা হয়। আমার আর এক সতীর্থ (বগুড়া এবং ঢাকা কলেজে) জি এম সিরাজের মাধ্যমে সেটা আরো ঘনিষ্ঠতা হয়। আমি তাকে ভালো মানুষ বলে জানতাম।’
মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, ‘আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো আসামির সঙ্গে নিষ্ঠুর বা অমানবিক আচরণ করা যায় না। সেখানে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল মজিদ হুমায়ূনের সঙ্গে যেটা ঘটেছে, তাঁর সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, সেটি মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন। একজন আসামি, যিনি মৃত্যুশয্যায়, তাঁর হাতেও হাতকড়া পরিয়ে রাখতে হবে?’
শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে, এই আশা মানুষ করেছিল উল্লেখ করে নূর খান বলেন, ‘কিন্তু মানুষের সেই প্রত্যাশা চরম হতাশায় পরিণত হয়েছে।’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন