লাইভ বেকারি: স্বাদে টাটকা, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভরা
![]() |
| ক্রেতার সামনেই বানানো হয় পাউরুটি, পেটিস, কেক, পেস্ট্রির মতো বেকারি পণ্য | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
রাজধানীর অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়েছে ‘লাইভ বেকারি’ নামে তাৎক্ষণিক খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বিক্রির দোকান। কিন্তু এসব দোকানে মানের কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভোক্তা টাটকা মনে করে পাউরুটি, বিস্কুট, টোস্ট, কেকসহ পণ্য কিনে খাচ্ছেন, কিন্তু স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার কোনো তদারকি নেই।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘লাইভ বেকারির সংখ্যা এত দ্রুত বেড়েছে যে আমরা এগুলোর হিসাব রাখতে পারছি না। কেউ কোনো ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই উৎপাদন শুরু করছে। আমরা তাদের সচেতন করার চেষ্টা করছি, কিন্তু এতগুলো প্রতিষ্ঠান একবারে বন্ধ করা সম্ভব নয়। আমাদের লোকবলও সীমিত, তাই যতটা কাজ করা দরকার, ততটাই করতে পারছি।’
অল্প জায়গায় স্বল্প পুঁজিতে ব্যবসা গড়া যায় বলে রাজধানীতে লাইভ বেকারির সংখ্যা লাফিয়ে বেড়েছে। মুগদা থানাধীন পূর্ব মানিকনগরের ঢোকার মুখ থেকে খালপাড় নতুন রাস্তার মোড় পর্যন্ত সাড়ে ৮০০ মিটার জুড়ে ৫টি লাইভ বেকারি দেখা যায়। শুধু মানিকনগর নয়, রাজধানীর কমলাপুর, মতিঝিল, খিলগাঁও, মালিবাগ, রামপুরা, বনশ্রী, মোহাম্মদপুরসহ প্রায় সব এলাকার বাজার, পাড়া-মহল্লায় শত শত লাইভ বেকারি গড়ে উঠেছে।
ছোট একটি দোকানে ওভেন, মিক্সচার মেশিন, ট্রে টেবিল ও কিছু আসবাব বসিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কেক, বিস্কুট, পাউরুটি, পেটিস, টোস্ট, মিষ্টিসহ নানা খাদ্যপণ্য তৈরি করা হচ্ছে।
ঝিগাতলার সোনালী ব্যাংক সংলগ্ন ‘বেকার্স বে’ লাইভ বেকারি থেকে দুটি চিজ রোল ও একটি চিকেন রোল কিনে ফিরছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পলাশ মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় খাদ্যপণ্য কিনি স্বাদ দেখে। কীভাবে মান যাচাই করব, তা জানি না। যে চিজ রোল আমি ৪০ টাকায় কিনেছি, ভালো কোনো দোকানে গেলে ৭০–৮০ টাকা লাগবে।’
পূর্ব মানিকনগরের খালিস বেকারির মালিক মো. জুবায়ের বলেন, ‘ভালো লাভের আশায় আরেক বেকারির মালিক আমাকে এই ব্যবসায় নামিয়েছে। কিছু টাকা দিয়ে সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছি। দেড় বছর আগে শুরু করেছিলাম, তখন কিছু লাভ হতো। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে আশপাশে বেকারির সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে, এখন লোকসানে আছি।’
প্রথমে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে কারখানা স্থাপন করতে হয়। তারপর নমুনা পণ্য উৎপাদন করে মান সনদের জন্য বিএসটিআইতে জমা দিতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন হয় ট্রেড লাইসেন্স, শিল্প-নকশা বা ট্রেড মার্ক রেজিস্ট্রেশনের সত্যায়িত ফটোকপি, ভ্যাট সনদ, প্রিমিসেস লাইসেন্স, কর্মচারীর স্বাস্থ্য সনদ, পণ্যের মোড়কের নকশার কাগজ। জানাতে হয় কালার, ফ্লেভার, প্রিজারভেটিভ, আর্টিফিশিয়াল সুইটনারসহ পণ্যের উপকরণ। পরীক্ষণের যন্ত্রপাতির তালিকা, কারখানার যন্ত্রপাতি, লে-আউট ও প্রসেস ফ্লো-চার্টও দিতে হয়। এরপর পরিদর্শকরা কারখানা পরিদর্শন করে সন্তুষ্ট হলে মান সনদ দেয়।
কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া মানা হচ্ছে না। অনেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই ব্যবসা শুরু করেন, কেউ নেই। সিংহভাগের কারখানিতে মানসনদ নেই। কারিগরদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ও স্যানিটেশন সনদও নেই।
বুয়েটের ২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের ৬৭ শতাংশ পাউরুটিতে নির্ধারিত মানের চেয়ে বেশি পটাশিয়াম ব্রোমেট রয়েছে, যা পাউরুটি ফোলাতে ব্যবহার হয়। এছাড়া বেকারি পণ্যে কাঁচামাল আটার সঙ্গে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ট্রান্সফ্যাট, কৃত্রিম রং ও সোডিয়াম সাইক্লোমেট ব্যবহৃত হচ্ছে।
রাজধানীতে কতটি লাইভ বেকারি রয়েছে, তা সিটি করপোরেশন বা বিএসটিআই-এর কাছে নেই। বিএসটিআই বলেছে, শত শত বেকারির মধ্যে মাত্র ২৭টির মান সনদ রয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাবিবুল আলম বলেন, ‘এসব ট্রেড লাইসেন্স করপোরেশনের জোনগুলো থেকে দেওয়া হয়। কতটি লাইসেন্স হয়েছে, তা আমাদের কাছে নেই।’
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি শফিকুজ্জামান বলেন, মানহীন এসব পণ্যে সাধারণের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। যারা আইন মেনে উৎপাদন করবে না, তাদের ব্যবসা বন্ধ করা উচিত। দু-একটি বন্ধ করলে বাকিগুলোও ঠিক হয়ে যেত।

Comments
Comments