ডাকসুতে ছাত্রদলের হার—বিএনপিকে যা ভাবতে হবে
![]() |
ছাত্রদল–সমর্থিত প্যানেলের সহ সভাপতি ( ভিপি) প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। ঢাকা, ৯ সেপ্টেম্বর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ডাকসুর নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনের আগে সংবাদমাধ্যমগুলো ধারণা দিয়েছিল, ত্রিমুখী লড়াই হবে এবং নির্বাচন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। বড় জাতীয় দল বিএনপিও ধরে নিয়েছিল, তাদের ছাত্রদলই তুমুলভাবে বিজয় পাবে, যদিও কিছু আসন শিবির ও অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছেড়ে দিতে হবে।
এখন ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল ‘জলবৎ তরলং’। এটা বিএনপি ও দেশের প্রগতিশীল চিন্তাধারায় বিশ্বাসী লোকদের জন্য এক ভূমিধস ঘটনা। বিএনপির ছাত্রদল হেরেছে, এটা অবশ্যই তাদের কাছে অপ্রত্যাশিত।
হ্যাঁ, নির্বাচনে হার-জিত থাকবেই, প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বিতীয় দল প্রথম দলকে হারাতে পারে, তা আমরা অনেক নির্বাচনে দেখেছি। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল যেভাবে হেরেছে, তা কোনো নির্বাচনী হিসাব-নিকাশে মিলবে না। এভাবে যেকোনো নির্বাচনে যখন একটা দল হারে, তা তারা নির্বাচনের মাঝপথেই বুঝতে পারে। কিন্তু ছাত্রদল তা বুঝতে পারেনি।
ছাত্রশিবির আগে কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনে জয়ের কাছে-কিনারে পৌঁছাতে পারেনি। তারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জিতেছিল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে প্রতাপ ঝেড়েছিল; কিন্তু কখনো ঢাকাতে নয়। এটা তাদের দুটি ছোট সুবিধা এনে দিয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী এই নির্বাচনে এবার অনেক রসদ জুগিয়েছে। তারা বদ্ধপরিকর ছিল ডাকসুতে এবার তাদের ছাত্রদের জেতাতে। দ্বিতীয় সুবিধাটা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা যেহেতু কখনো ক্ষমতায় ছিল না, হলগুলোতে তাদের পুরোনো ফাইল ছিল ক্লিন।
তবে সবচেয়ে বড় যে উপকরণ ছাত্রশিবিরের পক্ষে কাজে দিয়েছে সেটা হলো, জুলাই আন্দোলনে গড়ে ওঠা ‘গুপ্ত সেল’গুলো। এই বিদ্যা ছাত্রদল রপ্ত করতে পারেনি, তাই বারবার জুলাইওয়ালাদের কাছে হোঁচট খাচ্ছে।
এবার যদি ‘বিগ পিকচার’ বা বড় পরিসরে তাকাই—ডাকসুর নির্বাচনটা কী নিয়ে হয়েছে, তা ছাত্রদল বুঝতে পারেনি। বুঝলেও সম্ভবত তাদের তেমন কিছু করার ছিল না। তাদের বড় ভাইয়েরা ডাকসুর পথটা তাদের জন্য ‘পঙ্কিল’ করে রেখেছিলেন।
এত সংগ্রাম ও আন্দোলন করার পর সাধারণ ছাত্ররা চাচ্ছে একটা সম্পূর্ণ ক্লিন ইমেজের সংগঠন, যারা তাদের হলের সিট নিয়ে ভোগাবে না বা তাদের মুরব্বিরা ক্ষমতায় গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তা নিয়ে দাপট দেখাবে না ও ছাত্রনেতারা গাড়ি-ঘোড়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়াবে না। দুর্ভাগ্যবশত, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, এসব দাপট ছাত্রদলেরও ছিল। সত্য কথা বলতে গেলে, বিএনপির কোনো অঙ্গসংগঠনই এ ধরনের ‘পারসেপশন’ থেকে মুক্ত নয়। বিএনপিও যে এর থেকে বের হয়ে আসতে সত্যিকার কোনো চেষ্টা করেছে, তা জোর করে বলা যাবে না।
গত ৫ আগস্টের পর, ছাত্ররা বিএনপিকে ঘিরে দেশের আনাচকানাচে যা দেখছে, তা তাদের উত্ত্যক্ত করতে যথেষ্ট। চাঁদাবাজি, দখলদারি, চুরিচামারি এগুলোকে প্রতিরোধ করার জন্য তারা আন্দোলন করেছে, প্রাণ দিয়েছে। এখন কেন এগুলো মেনে নেবে?
কিন্তু এখনো এসব চলছে। জামায়াত প্রতিনিয়ত এসব নিয়ে বিএনপির দিকে আঙুল তুলছে এবং নিজেদের ‘ক্লিন ইমেজের’ সঙ্গে তুলনা করছে। বিএনপির একমাত্র উত্তর, দু-চারজন লোককে কয় দিনের জন্য বহিষ্কার করে চুপ করে থাকা।
এই যেন আপেলের ভেতরে পুরাটা পচে যাচ্ছে, আপনি একটু খোসা ছাড়িয়ে বললেন বাকিটা ভালো। তাই বলে জামায়াত ও শিবির কি ধোয়া তুলসীপাতা? অবশ্যই না। তাদের দুর্বলতা ও দেশের অস্থিরতায় তাদের অবদান আরও গভীরে। কিন্তু তাদের ওই সব বিষয়ে বলবে কে?
প্রশ্ন হচ্ছে, এখন বিএনপি ও ছাত্রদল কী করবে? তাদের এই ফলাফল মেনে নিয়ে অন্তত একটা ভালো সংস্কৃতি বা ‘ম্যানার’ দেখাতে হবে। নির্বাচনে এমন কোনো অনিয়ম ঘটেনি, যা তাদের জন্য ফলাফল উল্টে দিতে পারত। নির্বাচন নিয়ে তারা যত কাদা-ছোড়াছুড়ি করবে, তত বেশি সাধারণ ছাত্রদের রোষে পড়বে।
প্রথমে বলেছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের রেকর্ড ক্লিন। কিন্তু সত্যি কি এত ক্লিন? আমরা কি আমাদের শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীসহ আরও অনেক নাম—তাঁদের ভুলে গেছি? ছাত্রদল তো তাঁদের কথা বলেনি। চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্বেকার তাণ্ডবের কথাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছায়নি।
তবে বিএনপির সবচেয়ে বড় ভুল, জামায়াতের মবের বিরুদ্ধে তারা সব সময় চুপ ছিল। মব করে মানুষের বাড়ি ভাঙা হয়েছে, মানুষকে ধরে অত্যাচার করা হয়েছে, নিজেরা পুলিশ সেজে সভা-সমিতি ভেঙেছে কেউ প্রতিবাদ করেনি; বরং সরকারের সঙ্গে বিএনপিও তাদের প্রশ্রয় দিয়েছে। বিএনপি জামায়াতের দুর্বলতাগুলো তুলে ধরতে না পারায় তারা নিজেদের একটা ক্লিন ইমেজ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে ডাকসু নির্বাচন ছিল একটা টেস্ট। সেই নির্বাচনের প্রথম টেস্টেই তারা হেরে গেল। বলা যায় বিএনপির এই গোঁজামিলের রাজনীতি ছাত্রদলকে ডাকসুতে ডুবিয়েছে, বিএনপির জন্যও ভবিষ্যতে তা বিপদের কারণ হতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এখন বিএনপি ও ছাত্রদল কী করবে? তাদের এই ফলাফল মেনে নিয়ে অন্তত একটা ভালো সংস্কৃতি বা ‘ম্যানার’ দেখাতে হবে। নির্বাচনে এমন কোনো অনিয়ম ঘটেনি, যা তাদের জন্য ফলাফল উল্টে দিতে পারত। নির্বাচন নিয়ে তারা যত কাদা-ছোড়াছুড়ি করবে, তত বেশি সাধারণ ছাত্রদের রোষে পড়বে।
পরবর্তী পদক্ষেপ দলের বড় ভাইদের নিতে হবে। ‘আমরা বড় দল, আমরাই জয় লাভ করব'—এই মনোভাব ঝেড়ে ফেলে তাদের নিজেদের ‘আন্ডার-ডগ’ বা ‘হারু পার্টি’ ভেবে নতুন করে কাজ শুরু করতে হবে। গতানুগতিক রাজনীতি থেকে গা ঝাড়া দিয়ে তাদের বড় ধরনের দলীয় সংস্কার করতে হবে। জনগণকে দেখাতে হবে এবং জনগণকে সত্যিকার দেখতে হবে যে বিএনপি পরিবর্তিত হচ্ছে। শুকনা কথায় চিড়া ভিজবে না।
বিএনপি যদি দলীয় রাজনীতিতে শুদ্ধি না আনতে পারে এবং এই শুদ্ধতা যদি তারা জনগণকে দেখতে না পারে, তাহলে দেশটাই তাদের জন্য ডাকসু হয়ে যাবে। আমি আমার এক কলামে লিখছিলাম, ‘তারেক রহমান দুই লাইনের একটা সমন জারি করে স্বেচ্ছাসেবক দল ও যুবদলকে স্থগিত করে দিতে পারেন, তাদের মধ্যে যাদের ভালো ইমেজ আছে, তাদের বিএনপিতে স্থান দিতে পারেন। বিএনপির মতো এত বড় একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কেন এত অঙ্গসংগঠন লাগবে?’
বিএনপির একদম এটাই করতে হবে এমন নয়। তবে এ ধরনের বড় কিছু, যা জনগণের কাছে দৃশ্যমান হবে ও যাতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তাদের কেলেঙ্কারিগুলো জনগণকে আর দেখতে ও শুনতে হবে না। ডাকসুর নির্বাচন একটা জিনিস স্পষ্ট করেছে যে আওয়ামী লীগের বদনামগুলো গায়ে মেখে বিএনপি বেশি দূর এগোতে পারবে না।
● লেখক: ডাকসুর সাবেক সদস্য, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন