রাজশাহীতে সেই ভোজ হয়নি, নিরাপত্তা চেয়ে পাহাড়িয়াদের থানায় আবেদন
রাজশাহীর সেই পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও বাস্তুভিটা না ছাড়ার দাবিতে মানববন্ধন। আজ শুক্রবার দুপুরে নগরের মোল্লাপাড়া মহল্লায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
রাজশাহী নগরের মোল্লাপাড়ার পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের পরিবারগুলোকে উচ্ছেদের আগে আজ শুক্রবার খাসি জবাই করে যে ভোজের ঘোষণা দেওয়া হয়ছিল তা হয়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে পাহাড়িয়া পরিবারের সদস্যদের এবং জমির মালিক দাবিকারী সাজ্জাদ আলীকে ডেকেছিল পুলিশ। তবে পাহাড়িয়ারা সেখানে গেলেও সাজ্জাদ যাননি। পাহাড়িয়ারা নিরাপত্তা চেয়ে কাশিয়াডাঙ্গা থানায় একটি আবেদন করেছেন।
এদিকে আজ শুক্রবার দুপুরে পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের পরিবারগুলোর পক্ষে মানববন্ধন করেছেন রাজশাহীর বিক্ষুব্ধ নাগরিক, মানবাধিকার কর্মী, আদিবাসী সংগঠনের নেতা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বলেছেন, এই জমি পাহাড়িয়াদের দিতে হবে। যাতে কেউ দখল করতে না পারে, সেই দাবিতে তাঁরা সোচ্চার হয়েছেন।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের এই মহল্লার ১৬ কাঠা জমিতে ৫৩ বছর আগে বাড়ি করার সুযোগ পান মালপাহাড়িয়া জনগোষ্ঠীর ছয়টি পরিবার। তিন প্রজন্মে বাড়ি বেড়ে হয় ১৬টি। সম্প্রতি সাজ্জাদ আলী নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি দাবি করেন, ১৯৯৪ সালে তিনি এ জমি কিনেছেন। এখন দখল নেবেন। এ জন্য তিনি ভয় দেখিয়ে পাহাড়িয়াদের ১৬টি পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা দিয়েছেন। শুক্রবার খাসি জবাই করে তাঁদের খাওয়ানোর কথা ছিল। তিনটি পরিবার ইতিমধ্যে চলে গেছে। বিষয়টি জানাজানি হলে প্রশাসন ও নাগরিক সমাজের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়।
বৃহস্পতিবার পুলিশ গিয়ে জানিয়ে দেয়, কোনো খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হবে না। পাহাড়িয়ারা তাঁদের জমিতেই থাকবেন। আর সাজ্জাদ আলীর দলিল যাচাই-বাছাই করা হবে। পুলিশ পাহাড়িয়াদের ১৩টি পরিবারের ১৩ জন ও সাজ্জাদ আলীকে বৃহস্পতিবার বিকেলে কাশিয়াডাঙ্গা জোনের উপপুলিশ কমিশনারের (ডিসি) কার্যালয়ে ডেকেছিল। পাহাড়িয়ারা গেলেও সেখানে যাননি সাজ্জাদ আলী। তাঁকে শহরের বড়কুঠি ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ হোসেনও ডেকেছিলেন। সাজ্জাদ গিয়েছিলেন ভূমি অফিসে।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় হলেও ভয়ে আছেন পাহাড়িয়া জনগোষ্ঠীর পরিবারগুলো। তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তা চেয়ে বৃহস্পতিবার রাতে নগরের কাশিয়াডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছে আবেদন করেছেন। এতে বলা হয়, সাজ্জাদ আলী তাঁদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বসতবাড়ি থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করছেন। তাঁরা খুবই ভয়ের মধ্যে জীবন যাপন করছেন। চরমভাবে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁরা। এতে সই করেছেন বাবলু পাহাড়িয়া, সুধীর বিশ্বাস পাহাড়িয়া, দিশনি পাহাড়িয়া, মুনু পাহাড়িয়া, জরিনা পাহাড়িয়া, অধীর, গণেশ, শ্রাবণ, রিপন, নিতাই বিশ্বাস, শিপেন, উপেন রবিদাস, পরিমল চন্দ্র ওড়াও প্রমুখ।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আজ শুক্রবার দুপুরে সাজ্জাদ আলী বলেন, ‘আমি কোনো ভয় দেখাচ্ছি না। আমি সুন্দরভাবেই বিদায় দিতে চেয়েছিলাম। জমি আমার, আমি এটা ভূমি অফিসকে বলেছি। তারা আমাকে কিছু জানায়নি। তারা কী করছে সেটা আমি কিছু জানি না।’
এদিকে পাহাড়িয়া জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক কৈলাশ চন্দ্র রবিদাস জানিয়েছেন, তাঁর দলের প্রধান নাহিদ ইসলামও বিষয়টি অবগত। তিনিও পাহাড়িয়াদের পাশে থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। জেলা সমন্বয়ক কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী শামীমা সুলতানা সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখছেন।
আইনি সহায়তা দিতে পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। সংস্থার রাজশাহী ইউনিটের সমন্বয়কারী সামিনা বেগম তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ ছাড়া জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, আদিবাসী গবেষণা পরিষদ, সিসিবিভিও, পাহাড়িয়া ছাত্র পরিষদ, বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরাম, জুলাই ৩৬ পরিষদসহ নানা সংগঠন পাহাড়িয়াদের পাশে আছে।
পাহাড়িয়াদের বসতবাড়ি রক্ষা এবং তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে আজ সকালে ওই মহল্লায় মানববন্ধন হয়। এতে বক্তব্য দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গোলাম সারোয়ার, আদিবাসী গবেষণা পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, বাসদের জেলা শাখার সদস্যসচিব শামসুল আবেদীন, এনসিপি নেত্রী শামীমা সুলতানা, মানবাধিকার কর্মী আরিফ ইথার, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক সুভাষ চন্দ্র হেমব্রম, দপ্তর সম্পাদক প্রদীপ লাকড়া, পাহাড়িয়া ছাত্র পরিষদের উত্তম সিংহ প্রমুখ। এ ছাড়া মানববন্ধনে অংশ নেন আদিবাসী গবেষক রতন টপ্পো, বেসরকারি সংস্থা সিসিবিভিওর প্রতিনিধি বিপ্লব মুর্মু, সাংস্কৃতিক কর্মী সাগর হোসেন, বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনুপম প্রান্ত টুডু, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুশান্ত হেমব্রম, এডিশন মিনজ, তৃতীয় লিঙ্গের আবুল হাসনা পলি এবং পাহাড়িয়া জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষেরা।
মানববন্ধনে এক পাহাড়িয়া নারী বলেন, ‘আমাদের দাবি, আমরা এখানেই থাকতে চাই। এই জায়গা আমরা ছাড়তে চাই না।’ আরেক তরুণী বলেন, ‘আগে আমরা ভয় পেয়েছিলাম, তাই জায়গা ছেড়ে দিচ্ছিলাম। সংবাদ প্রকাশের পর সবাই এসেছেন।’
আদিবাসী গবেষণা পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে আদিবাসীরা দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে বাস করছে। একদল ভূমিদস্যু এটা দখল করতে চায়। আমরা মনে করি, এই জমি তাঁদের, তাঁরা থাকবে। তাঁদের উচ্ছেদ আমরা মানব না। আমরা দলমত সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে সবাই এসেছি। এই জমি আদিবাসীদের, এখানেই তারা থাকবে।’
জানতে চাইলে কাশিয়াডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজিজুল বারী বলেন, ‘নিরাপত্তা চেয়ে পাহাড়িয়ারা আমাদের কাছে আবেদন করেছেন। এরপর রাতেই আমি সাজ্জাদ আলীকে থানায় ডেকেছিলাম। তিনি নিশ্চিত করেছেন, পাহাড়িয়াদের তিনি কোনো ঝামেলা করবেন না। তিনি আইনি প্রক্রিয়ায় যাবেন।’ ওসি বেলা তিনটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক্ষুনি আমি ঘটনাস্থল থেকে এলাম। তাঁরা ভালোই আছে। তাঁদের কোনো শঙ্কা নেই।’
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন