প্রতিনিধি কক্সবাজার
![]() |
ট্রেন দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া শিশু আতাউল্লাহ | ছবি: পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া |
একসঙ্গে চারজনের মৃত্যুর ঘটনায় পরিবারের সবাই ছিলেন শোকে কাতর। এরই মধ্যে হঠাৎ রাতে ফিরে এল এক শিশু। দুর্ঘটনায় তারও মৃত্যু হয়েছে বলে ভেবেছিলেন সবাই। শিশুটির অপ্রত্যাশিত এই বেঁচে যাওয়া শত শোকের মধ্যে যেন সান্ত্বনার পরশ পরিবারটির কাছে।
কক্সবাজারের রামুর রশিদনগর রেলক্রসিংয়ে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় এক পরিবারের চারজনসহ পাঁচজনের মৃত্যুর খবর জানা গিয়েছিল গতকাল শনিবার দুর্ঘটনার পর। হতাহত ব্যক্তিদের স্বজনেরাও এক পরিবারের চারজনসহ পাঁচজনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছিলেন। মৃতদের তালিকায় নাম ছিল সাড়ে তিন বছর বয়সের আতাউল্লাহরও। কিন্তু রাতে আতাউল্লাহকে নানাবাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যান শিশুটি যে মাদ্রাসায় পড়ে, সেখানকারই কেউ একজন। নানা জাফর আলম তাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ভেবেছিলেন দুই মেয়ে, নাতিদের কেউই বেঁচে নেই। আতাউল্লাহর এই ফিরে আসা তাই তাঁর কাছে ছিল অবিশ্বাস্য।
কক্সবাজার সদর উপজেলার ভারুয়াখালীর সাবেক পাড়ায় জাফর আলমের বাড়ি। শনিবার দুপুরে সেখান থেকেই জাফর তাঁর দুই মেয়ে ও দুই নাতিকে বিদায় দিয়েছিলেন। ভারুয়াখালী থেকে তাঁরা ঈদগাঁও উপজেলার মেহেরঘোনায় যাচ্ছিলেন। সেখানে জাফরের বড় মেয়ে আসমাউল হোসনার শ্বশুরবাড়ি। মেয়ে ও নাতিদের বিদায় দেওয়ার আধঘণ্টা পরই জাফর দুর্ঘটনার কথা জানতে পারেন। দুর্ঘটনাস্থল রশিদনগরে ছুটে গিয়ে দেখেন খণ্ড খণ্ড হয়ে যাওয়া দেহাবশেষ। অটোরিকশায় থাকা দুই মেয়ে ও দুই নাতি-নাতনির সবাই মারা গেছে বলে ভেবেছিলেন তখন। কিন্তু আতাউল্লাহর ফিরে আসার পর জানতে পারলেন, বেঁচে আছে তাঁর নাতি।
কিন্তু কীভাবে বেঁচে গেল আতাউল্লাহ? আজ রোববার সকালে মুঠোফোনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জাফর আলম। তিনি বলেন, অটোরিকশায় ঈদগাঁওয়ের মেহেরঘোনায় রওনা দেন তাঁর দুই মেয়ে আসমাউল হোসনা (২৭) ও রেণু আরা আক্তার (১৩) এবং আসমার সাড়ে তিন বছরের ছেলে আতাউল্লাহ ও দেড় বছরের ছেলে আশেক উল্লাহ। খবর পেয়ে দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারেন, কেউই বেঁচে নেই। মারা গেছেন অটোরিকশাচালক হাবিব উল্লাহও (৫০)।
![]() |
কক্সবাজারের রামুতে ট্রেন দুর্ঘটনায় দুই মেয়ে ও এক নাতিকে হারিয়ে আহাজারি করছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জাফর আলম। গতকাল বিকালে রামুর রশিদনগরে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
জাফর বলেন, ‘দুই মেয়ে ও দুই নাতিকে হাসিমুখেই বাড়ি থেকে বিদায় দিয়েছিলাম। আধা ঘণ্টা পরই দুর্ঘটনার খবর এল। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে মেয়ে ও নাতিদের দেহের খণ্ড খণ্ড অংশ। এমন গা শিউরে ওঠা দৃশ্য দেখতে হবে, কল্পনাও করিনি।’
জাফর আলম একটু থেমে আবারও বলা শুরু করেন, ‘ধারণা করেছিলাম, অটোরিকশাতে ওঠা দুই মেয়ে, দুই নাতির সবাই মারা গেছে। কিন্তু রাতে সাড়ে তিন বছর বয়সী নাতি আতাউল্লাহকে তার মাদ্রাসা থেকে কেউ বাড়িতে রেখে যায়। জানতে পারি, অটোরিকশায় ওঠার পর পথে ঘোনারপাড়া এলাকার একটি মাদ্রাসায় আতাউল্লাহকে নামিয়ে দেয় আমার মেয়ে আসমা। এ কারণে বেঁচে যায় সে।’
পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, শনিবার বেলা দেড়টার দিকে রামু উপজেলার রশিদনগর ইউনিয়নের ধলিরছড়া রেলক্রসিং এলাকায় কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় এক পরিবারের চারজনসহ পাঁচজনের মৃত্যুর খবর জানা গিয়েছিল। কিন্তু পরে রাতে এক শিশু তার নানার বাড়িতে ফিরে আসায় মৃতের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৪–এ।
দুর্ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ জনতা রশিদনগরে স্থায়ী রেলগেট করার দাবিতে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারগামী সৈকত এক্সপ্রেস ট্রেন কয়েক ঘণ্টা আটকে রেখে বিক্ষোভ করেন। এ সময় ট্রেনে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন নিহত আসমাউলের স্বামী জিন্নাত উল্লাহও (৪০)। সেখানে স্ত্রী ও সন্তানের ছিন্নভিন্ন টুকরা পড়ে থাকতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে তাঁর স্ত্রী আসমা দুই ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি ভারুয়াখালীতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ছোট বোন রেণুকে নিয়ে তাঁরা চারজন অটোরিকশায় উঠে মেহেরঘোনাতে ফিরে আসছিলেন। ট্রেন দুর্ঘটনায় সব শেষ। তবে রাতে আতাউল্লাহর ফিরে আসার খবর পান তিনি। ভারুয়াখালী থেকে নানা জাফর আলম তাকে নিয়ে আসেন ঈদগাঁও উপজেলার মেহেরঘোনায় জিন্নাতের কাছে।
রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. তৈয়বুর রহমান প্রথমে গণমাধ্যমে এক পরিবারের চারজন, অটোরিকশাচালকসহ পাঁচজনের মৃত্যুর খবর প্রকাশ করেছিলেন। শনিবার রাতে আতাউল্লাহ ফিরে আসায় পুলিশ দুর্ঘটনায় চারজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে। এ প্রসঙ্গে তৈয়বুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনায় সময় মরদেহগুলো দেখে অটোরিকশার পাঁচ যাত্রীর সবাই মারা গেছে ভাবা হয়েছিল। জাফর আলমসহ পরিবারের সদস্যরা চারজনের মৃত্যুর খবর পুলিশকে নিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু রাতে অটোরিকশার যাত্রী শিশু আতাউল্লাহ ফিরে আসায় সংখ্যাটা কমে দাঁড়ায় ৪–এ।