চালের দাম কেন বাড়ছে, কারণ অজানা
বন্যা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের ক্ষতি হলে উৎপাদন কমে যায়। এ কারণে বাজারে চালের অভাব দেখা দেয় ও দাম বাড়ে।![]() |
চাল | ফাইল ছবি |
দেশের বাজারে চালের দাম বাড়ছে কয়েক দিন ধরেই। মোটা, মাঝারি বা সরু সব ধরনের চালের দামই বাড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, পর্যাপ্ত উৎপাদন ও সরবরাহের পরও চালের দাম বৃদ্ধির কোনও কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু কী কারণে দাম বাড়ছে তা জানেন না কেউ।
বাজারে ৫০ থেকে ৫৪ টাকা কেজি দরের মোটা চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬২ টাকা কেজিতে। মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৮ থেকে ৮০ টাকায়। নাজির শাইল ৮৩ থেকে ৮৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সম্প্রতি বোরোর নতুন চাল বাজারে ওঠার পর যে সরু চালের দাম কমে ৭৫ টাকা হয়েছিল, এখন তা আবার ৮৩ থেকে ৮৫ টাকায় পৌঁছেছে।
বর্তমানে দেশে চালের দাম বৃদ্ধির কোনও নির্দিষ্ট কারণ জানা না গেলেও কিছু বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মজুতদারি এবং আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব। বলা হচ্ছে বন্যা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের ক্ষতি হলে উৎপাদন কমে যায়। এ কারণে বাজারে চালের অভাব দেখা দেয় ও দাম বাড়ে।
এছাড়া কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার উদ্দেশ্যে চাল মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, যা দাম বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে চালের দাম ওঠানামা করলে প্রভাব আমাদের দেশের বাজারেও পড়ে। চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিলেও বাজারে তার প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে দেখা যায়নি। কিছু ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপের পরও দাম বেড়ে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এছাড়া পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, শ্রমিক সংকট এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কারণেও দাম প্রভাবিত হতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
চালের মোকাম বলে খ্যাত নাটোর ও নওগাঁয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদের টানা ছুটিতে ব্যাহত হয় উৎপাদন। এছাড়া আষাঢ় ও শ্রাবণে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের জন্য ধান শুকাতে পারেননি কৃষকরা। এতে নষ্ট হয়ে যায় অনেক ধান। তাই মণপ্রতি ধানের দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। অন্যদিকে বড় প্রতিষ্ঠানের কারসাজিতে বাজার আরও অস্থির হয়েছে। দাম বৃদ্ধির জন্য এমন যুক্তি তুলে ধরছেন মিল মালিকরা।
জানা গেছে, চলতি মৌসুমে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। চালের মজুতে রেকর্ড গড়েছে সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারেও দাম নিম্নমুখী। এছাড়া বাজার স্থিতিশীল রাখতে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমোদন, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ওএমএস এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণসহ সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও চালের বাজার উত্তপ্ত। দাম বৃদ্ধির পেছনে দেশের করপোরেট সিন্ডিকেটকেই দুষছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি বন্যাকেও অজুহাত হিসেবে দেখতে চাচ্ছেন অনেকেই। তবে এটিকে অস্বাভাবিক বলছেন বাজার বিশ্লেষক ও ক্রেতা-বিক্রেতারা।
এদিকে চালের পাশাপাশি আটা, পেঁয়াজ, ডাল, মাছ-মাংসসহ অনেক পণ্যের দাম একসঙ্গে বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। তারা মনে করেন সিন্ডিকেটের কাছে সরকার অসহায়।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে বার্ষিক চালের চাহিদা ৩ কোটি ৮০ থেকে ৩ কোটি ৯০ লাখ টন। মোট চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশই পূরণ হয় বোরো মৌসুমের আবাদে। বাকিটা আসে আমন আর আউশ থেকে। স্বাভাবিকভাবেই প্রতি বছর মৌসুমের এই সময়টাতে চালের দাম সহনীয় থাকে। কিন্তু এ বছর বাজারের চিত্র ভিন্ন।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারের কাছেও চালের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বোরো মৌসুমে রেকর্ড ২ কোটি ১৪ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়েছে। একইসঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুত ২১ লাখ ৪৩ হাজার ১৮৭ টন। এর মধ্যে ১৮ লাখ ৯৯ হাজার ৬২৪ টন চাল ও ১ লাখ ১ হাজার ৫৩০ টন ধান মজুত রয়েছে। সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, উৎপাদন ও মজুতের দিক থেকে চালের তেমন ঘাটতি নেই। তারপরও তিন মাস ধরে অর্থাৎ বোরোর ভরা মৌসুমেই চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী।
এদিকে, চালের বাজারে এমন অস্থিরতার জন্য মিল মালিক ও করপোরেট সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। তবে মিল মালিকদের দাবি, চালের দাম বাড়ার জন্য করপোরেট গ্রুপগুলো একমাত্র দায়ী। বাজারে সরকারের সুষ্ঠু তদারকি নেই বলেও অভিযোগ রয়েছে।
দেশের বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাস দেড়েক ধরে উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে চাল। মোটা চালের দামই এখন ৬০ টাকার বেশি। মাঝারি মানের মিনিকেট ও নাজিরশাইল ৬৫-৭০ টাকায় পাওয়া যায়। এছাড়া বাকি সব চাল সাধারণত ৭৫-৮৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। আর খুব ভালো মানের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চালের দাম ৯০ থেকে ১০০ টাকার কাছাকাছি। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকায় স্থানভেদে ১৫ দিনের ব্যবধানে মোটা চালের দাম খুচরা বাজারে কেজিতে বেড়েছে চার থেকে ছয় টাকা। পাশাপাশি অন্য সব চালের দামও কেজিতে পাঁচ-ছয় টাকা বেড়েছে। শুল্কমুক্ত আমদানি হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের গত এক বছরে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চালের দাম বেড়েছে অন্তত ৪০০ টাকা; যার দাম গত বছর ছিল ২ হাজার ৯০০ থেকে ৩ হাজার ১০০ টাকা।
রাজধানীর কাওরান বাজারের চালের পাইকারি ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেন বলেন, সরবরাহ ঠিক আছে, তবু চালের দাম বাড়ছে।
একই বাজারের ব্যবসায়ী এম এ রশিদ জানান, মোটা চাল এখন কম পাওয়া যায়। তবু প্রতি কেজি ৬০ টাকা। ৫০ কেজির বস্তা, চিকন সব ধরনের চালের দামই এখন চার হাজার টাকার ওপরে। বস্তায় দাম বেড়েছে অন্তত ৪০০ টাকা।
দেশের বাজারে বাড়লেও বিশ্ববাজারে চালের দাম কমছে। ট্রেডিং ইকোনমিকস বলছে, বিশ্ববাজারে চালের দাম এক মাসে কমেছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি বছরের সাত মাসে ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ কমেছে। আর এক বছরে একই সময়ের তুলনায় কমেছে ১৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ীও চলতি বছরে সব ধরনের চালের মূল্যসূচক ১৩ শতাংশ কমেছে। সংস্থাটির মতে, সবচেয়ে বড় রফতানিকারক দেশ ভারতের রেকর্ড উৎপাদন ও রফতানি নিষেধাজ্ঞা ধাপে ধাপে তুলে নেওয়ায় বাজারে সরবরাহ বাড়ায় দাম কমেছে। এর পাশাপাশি উৎপাদন বেড়েছে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশে। বিশ্ববাজারে চালের দাম ক্রমেই নিম্নমুখী হলেও বাংলাদেশের বাজারে ভিন্ন চিত্র।
রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার দরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সরু জাতের নাজিরশাইল ও মিনিকেট ১৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ, মাঝারি জাতের পাইজাম ও আটাশ ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং মোটা জাতের স্বর্ণা ও চায়না ইরি চালের দাম ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেড়েছে।
টিসিবির ঢাকা মহানগরীর দৈনিক খুচরা বাজার দরের তথ্য অনুযায়ী, সরু চাল ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৬০ থেকে ৭০ টাকা এবং মোটা চাল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাবুবাজার বাদামতলী চাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন বলেন, চালের বাজার বৃদ্ধির কোনও কারণ নাই। তারপরও বাড়ছে। কেন বাড়ছে জানি না। তবে চালের মোকাম বলে পরিচিত নাটোর ও নওগাঁয় দাম বেড়েছে বলে আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
জয়পুরহাটের চালকল মালিক সমিতির নেতা লায়েক আলী জানান, পণ্য নষ্ট হওয়ার কারণে ধানের দাম মাসখানেকের ব্যবধানে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়েছে। এ কারণে বেড়েছে চালের দাম। বৃষ্টিতে চালের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে এটা স্বাভাবিক হবে বলে আশা করেন তিনি।
খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত রয়েছে। তারপরও চালের দাম বৃদ্ধির কোনও কারণ নাই। খুব শিগগিরই চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসবে।
তিনি বলেন, গতবারের তুলনায় এবার ৩ লাখ টন বেশি চাল মজুত রয়েছে। এবার বোরো ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি হয়েছে। ইতোমধ্যে ৭২ শতাংশ ধান ও চাল সংগ্রহ সম্পন্ন হয়েছে।
সংকট নিরসনে প্রস্তুতির বিষয়ে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ওএমএসসহ অন্যান্য কার্যক্রম শুরু করা হবে, যাতে সাধারণ মানুষকে বিপাকে পড়তে না হয়। চলতি মৌসুমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে অতীতের যেকোনও সময়ের তুলনায় বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। দেশে খাদ্য মজুত বর্তমানে অত্যন্ত সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে বলেও জানান খাদ্য উপদেষ্টা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন