প্রতিনিধি কয়রা
![]() |
কয়রার শাকবাড়িয়া নদীর তীরে রত্নাঘেরির বাঁধের ওপর মাটির দেয়াল তৈরি করেছেন স্থানীয় লোকজন। গত ২২ জুলাই তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের রত্নাঘেরি গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শাকবাড়িয়া নদী। ওপারে দাঁড়িয়ে আছে সবুজে মোড়া সুন্দরবন। নদীর ঢেউ আর জোয়ারের গর্জনে আতঙ্কে থাকেন নদীপারের মানুষ। এলাকার বাসিন্দাদের এখন একমাত্র ভরসা একফালি মাটির বাঁধ। আর সেই বাঁধের ওপর হাতে গড়া নতুন দেয়াল।
সম্প্রতি এক সকালে কাদামাখা বাঁধের ওপরের সরু পথ ধরে বাজারের ব্যাগ হাতে হেঁটে যাচ্ছিলেন অরবিন্দ কুমার। এক হাতে শার্ট গুটিয়ে কাদায় সাবধানে পা ফেলছিলেন। কাছে গিয়ে কথা বলতেই তিনি হেসে বললেন, ‘ভাই, নদী এখন আর আগের মতো শান্ত নেই। জোয়ারের পানি বাঁধ ছাপায়ে গ্রামে ঢুকতি চায়। একবার যদি ঢুকে পড়ে, ঘরবাড়ি সব ভাইসে যাবে। তাই আর কারও মুখের দিকি না চায়ি এই বাঁধের ওপর আমরা নিজেরাই দেয়াল তুলিছি।’
জোয়ারের পানি থেকে বাঁচতে এই দেয়াল রত্নাঘেরির মানুষেরা গড়েছেন। প্রায় এক কিলোমিটার বাঁধের ওপর নদীর চরের মাটি কেটে, ঝুড়ি আর কোদাল হাতে নিয়ে দেয়াল তুলেছেন গ্রামের মানুষ। শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে পাথরখালী মিলনী যুব সংঘের সভাপতি অভিজিৎ মহলদার জানান, সেই দেয়াল তৈরির কথা।
অভিজিৎ বলেন, ‘এই জায়গাটা খুব নিচু। জোয়ার একটু বাড়লেই পানি বাঁধ ছাপিয়ে ঢুকে পড়ে। তাই সম্প্রতি দুই শতাধিক যুবক আর গ্রামের নারী-পুরুষ মিলে আমরা স্বেচ্ছাশ্রমে মাটি কেটেছি, বস্তা টেনেছি, বাঁধের ওপর দেয়াল তুলেছি। আমাদের গ্রামে বেশির ভাগ মানুষ দিনমজুর। একদিন কাজ না করলে চুলায় আগুন জ্বলে না। তবুও সেদিন সবাই রোজগার ফেলে কোদাল হাতে নিয়েছে। কেউ মাটি কেটেছে, কেউ বস্তায় ভরেছে, কেউ দেয়ালে বসিয়েছে। কারণ আমরা জানি, একবার বাঁধ ভাঙলে কেমন কষ্ট হয়।’
রত্নাঘেরির এই দৃশ্য আসলে কয়রা উপজেলার প্রতিচ্ছবি। সরেজমিনে কয়রার মহেশ্বরীপুর, নয়ানি, বাবুরাবাদ, চৌকুনি, তেঁতুলতলার চর, মঠবাড়ি, হায়াতখালী যেখানেই যাওয়া যায়, দেখা যায় বাঁধের ওপর বানানো নতুন মাটির দেয়াল। ষাটের দশকে বানানো বাঁধগুলো এখন আর জোয়ারের পানি সামলাতে পারে না। নদীর বুক ভরাট হয়ে গেছে পলিতে, জেগেছে চর। বাঁধ উপচে পানি চলে আসে গ্রামে।
মহেশ্বরীপুরের অনুপম কুমার বলেন, ১০ বছর আগে এই নদীতে জোয়ারের সময় ৭০-৮০ হাত পানি থাকত। এখন পলি পড়ে থাকে ২৫-৩০ হাত। নদীর তলা যত ভরে, ততই জোয়ারে পানি উঁচু হয়। বাঁধ উপচে পানি ঢোকে। তাই নিজেরাই মাটি তুলে দেয়াল বানিয়েছেন।
উত্তর বেদকাশীর শাকবাড়িয়া নদীর ধারে দাঁড়িয়ে স্থানীয় বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম জানান, ‘প্রতি জোয়ারে গাঙের পানি এমন ওঠে, বুক ধড়ফড় করে। আগে ভরা জোয়ারে বাঁধের অর্ধেক পর্যন্ত পানি উঠত, এখন কানায় কানায় উঠে যায়। তাই আমরা দেয়াল তুলছি, না হলে গ্রাম তলিয়ে যেত।’
![]() |
কয়রার মহেশ্বরীপুর, নয়ানি, বাবুরাবাদ, চৌকুনি, তেঁতুলতলার চর, মঠবাড়ি, হায়াতখালী এলাকায় বাঁধের ওপর মাটির দেয়াল বানানো হয়েছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারী বলেন, ষাটের দশকের বাঁধ দিয়ে আর চলবে না। পাউবোকে কতবার বলা হয়েছে, কিছু হয় না। তাই মানুষ নিজেরাই কোদাল হাতে নিয়েছে, দেয়াল তুলেছে।
বাঁধের উচ্চতার অন্তত ১০ ফুট বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ’৯০ দশকের পর পলি জমে নদীগুলো ভরাট হতে শুরু করে। ২০০৭ সালের সিডরের পর তা ভয়াবহ আকার নেয়। নদী ভরাট হওয়ায় বাঁধগুলো আর চাপ নিতে পারে না। যদি বাঁধের অন্তত ১০ ফুট উচ্চতা না বাড়ানো হয়, উপকূলের ক্ষতি ঠেকানো যাবে না।
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, কয়রার ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের স্থানগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। রত্নাঘেরি, বাবুরাবাদ থেকে চৌকুনি হয়ে তেঁতুলতলার চর পর্যন্ত বাঁধ মেরামতের জন্য বাজেট চাওয়া হয়েছে। দ্রুতই অনুমোদন হবে বলে আশা করা যায়। রত্নাঘেরি থেকে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের কাটকাটা পর্যন্ত বাঁধের কাজের জন্য ঠিকাদারও নিয়োগ হয়ে গেছে, শিগগিরই কাজ শুরু হবে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফেরাতে পলি অপসারণেরও পরিকল্পনা আছে।