হাতি বাঁচাতে রেলে ৪০ কোটি টাকার প্রকল্প
প্রতিনিধি চট্টগ্রাম
![]() |
| ছবির ক্যাপশান, রামু একটি বন্য হাতি অধ্যুষিত এলাকা। কিছুদূর পরপরই এখানে বন বিভাগের হাতি বিষয়ক সতর্কবার্তা চোখে পড়বে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
পর্যটন শহর কক্সবাজারে ট্রেন নিয়ে যেতে সংরক্ষিত বনের ভেতরে নির্মিত হয়েছে রেলপথ। এমন জায়গায় রেললাইন তৈরি করা হয়েছে, যেটি ছিল এশিয়ান হাতির করিডর (চলচলের পথ)। এভাবে লাইন স্থাপনের কারণে হাতির চলাচলের পথে বাধা তৈরি হয়। যদিও হাতির চলাফেরা নির্বিঘ্ন করার জন্য রেললাইনের ওপর নির্মাণ করা হয় ওভারপাস ও আন্ডারপাস। এরপরও দুর্ঘটনা ঘটছে।
চলাচলের পথে মনুষ্য সৃষ্ট এমন বাধা উপেক্ষা করে ঠিকই বনে নিজের রাজ্যে ঘোরাঘুরি করে হাতির দল। কখনো কখনো রেললাইনের ওপর চলে আসে হাতি। এতে তৈরি হয় মৃত্যুর ঝুঁকি। ইতিমধ্যে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ গেছে একটি হাতির বাচ্চার। অল্পের জন্য রক্ষা পায় আরেক হাতি।
রেললাইনে এসে বিপণ্নপ্রায় এশিয়ান হাতির যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সে জন্য ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে রেলওয়ে। দেশের বাইরে থেকে আনা হচ্ছে এসব ক্যামেরা। মূলত এগুলো সেন্সর ক্যামেরা হিসেবে কাজ করবে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে হাতি চলাচলের যেসব পথ রয়েছে, সেখানে বসানো হবে ক্যামেরাগুলো।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, ক্যামেরা কেনার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। বিদেশ থেকে ক্যামেরাগুলো দেশে আনা হচ্ছে। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে চলতি বছরের মধ্যে ক্যামেরা স্থাপনের কাজ শেষ করতে চান তাঁরা।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের পর ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। বর্তমানে এই রেলপথ দিয়ে দিনে ও রাতে চার জোড়া ট্রেন চলাচল করছে।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মিত ১০৩ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথের ২৭ কিলোমিটার গেছে সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে। লোহাগাড়ার চুনতি, ফাঁসিয়াখালী ও মেধাকচ্ছপিয়া সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে এই রেলপথ গেছে। রেললাইন নির্মাণ করার জন্য বনের ২০৭ একর জায়গাকে সংরক্ষিত বন থেকে বাদ দেওয়া হয়।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, ক্যামেরা কেনার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। বিদেশ থেকে ক্যামেরাগুলো দেশে আনা হচ্ছে। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে চলতি বছরের মধ্যে ক্যামেরা স্থাপনের কাজ শেষ করতে চান তাঁরা।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চুনতি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য চট্টগ্রাম জেলার লোহাগড়া ও বাঁশখালী উপজেলা এবং কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলায় অবস্থিত। এর আয়তন ১৯ হাজার ১৮৫ একর। এটি প্রাকৃতিকভাবেই গর্জনগাছ প্রধান এলাকা। আগে এ অঞ্চলে ঘন গর্জন বন থাকলেও বর্তমানে অল্প কিছু গর্জনগাছ অতীতের সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। এ বনের উল্লেখযোগ্য প্রাণীদের মধ্যে হাতি অন্যতম। বর্তমানে চুনতি অভয়ারণ্যে প্রায় ৪০ থেকে ৫০টি হাতি আছে। এই হাতির পাল লোহাগাড়া, বাঁশখালী ও চকরিয়ার বনজুড়ে চলাচল করে। এ জন্য রেললাইন পার হতে হয়।
রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক ও প্রকল্প পরিচালক মো. সবুক্তগীন বলেন, সংরক্ষিত বনের ভেতরে ২৭ কিলোমিটার রেললাইন রয়েছে। হাতির করিডর থাকায় ওভারপাস, আন্ডারপাস নির্মাণসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। হাতির পাল এসব আন্ডারপাস ও ওভারপাস ব্যবহার করে। তারপরও মাঝেমধ্যে রেললাইনে চলে আসে। এখানে আসার পর যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে, সে জন্য ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো রোবোটিক ও সেন্সর ক্যামেরা হিসেবে কাজ করবে। এর সঙ্গে সংকেতব্যবস্থা যুক্ত থাকবে।
প্রকল্প পরিচালক মো. সবুক্তগীন বলেন, ক্যামেরাগুলো হাতির অবয়ব চিহ্নিত করতে পারবে। যদি কখনো হাতি বা হাতির পাল রেললাইনে চলে আসে, তাহলে তা ছবি আকারে সিগন্যাল বা সংকেত পাঠাবে। এই সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রেললাইনের পাশে থাকা লাল বাতিগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলে উঠবে। এই লাল বাতি দেখে চলন্ত ট্রেনের ট্রেনচালক (লোকোমাস্টার) বুঝতে পারবেন, রেললাইনে হাতির পাল বা হাতি রয়েছে। তখন তিনি ট্রেনের গতি কমাবেন এবং থামাবেন।
সংরক্ষিত বনের ভেতরে ২৭ কিলোমিটার রেললাইন রয়েছে। হাতির করিডর থাকায় ওভারপাস, আন্ডারপাস নির্মাণসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। হাতির পাল এসব আন্ডারপাস ও ওভারপাস ব্যবহার করে। তারপরও মাঝেমধ্যে রেললাইনে চলে আসে। এখানে আসার পর যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে, সে জন্য ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
— মো. সবুক্তগীন, রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক ও প্রকল্প পরিচালক
প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, এই ছয়টি ক্যামেরার সঙ্গে আনুষঙ্গিক সংকেতবাতি স্থাপন, বৈদ্যুতিক কাজ রয়েছে। সব মিলিয়ে এতে ব্যয় হবে প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এসব ক্যামেরা কীভাবে কাজ করবে, সংকেতব্যবস্থা কেমন হবে, তার ওপর ট্রেনচালক ও পরিচালকদের (গার্ড) প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে এক দফা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন চলাচলের এক বছরের মধ্যে ট্রেনের ধাক্কায় হাতি মারা গিয়েছিল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথে। গত বছরের ১৩ অক্টোবর রাত সাড়ে আটটার দিকে রেলপথের ওপর দিয়ে পার হওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্কায় মারা যায় একটি বাচ্চা হাতি। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে আসা ঈদ স্পেশাল-১০ ট্রেনের ধাক্কায় হাতিটি প্রথমে আহত হয়েছিল।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যের এলিফ্যান্ট ওভারপাসের (রেললাইনের ওপর দিয়ে হাতি পারাপারের পথ) উত্তর পাশে এ ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার দুই দিন পর রেলওয়ের একটি উদ্ধারকারী ট্রেনে করে আহত হাতিটিকে ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের বন্য প্রাণী হাসপাতালে নেওয়া হয়। ওই দিন বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাতিটির মৃত্যু হয়।
হাতির মৃত্যুর পর এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয় রেলপথ মন্ত্রণালয়। গত ২৩ অক্টোবর অফিস আদেশে বলা হয়, দেশের বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য ও জাতীয় উদ্যান এলাকা অতিক্রম করার সময় ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার চুনতি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য এলাকায় এই ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল গত ২২ জুলাই রাত ১০টা ২৫ মিনিটে। ওই দিন রাতে রেললাইনে ছিল একটি হাতি। ওই সময় কক্সবাজার থেকে আসছিল চট্টগ্রামগামী সৈকত এক্সপ্রেস। দূর থেকে হাতি দেখতে পেয়ে তাৎক্ষণিক বা হার্ড ব্রেক চেপে ট্রেন থামান লোকোমাস্টার আবদুল আওয়াল। হাতি যেখানে অবস্থান করছিল, তার ঠিক আগে গিয়ে ট্রেন থামে। এরপর হাতি যাতে সরে যায়, এ জন্য ঘনঘন হুইসেল দিতে থাকেন ট্রেনচালক। এতে হাতি নিচে নেমে যায়। তবে ‘বিরক্ত’ হয়ে হাতির পালে একটি হাতি রেললাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের শেষ বগিতে ধাক্কা দেয়। অবশ্য দ্রুত ট্রেন ছেড়ে দিলে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
হাতির জন্য রেললাইনে ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের উপবন সংরক্ষক আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ। তিনি বলেন, ‘হাতি রক্ষায় এই ধরনের ক্যামেরা বা সেন্সর বসানোর জন্য রেলওয়েকে আমরা অনেক আগে থেকে বলে আসছি। আগে একবার ট্রেনচালকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে আর তা বসানো হয়নি। এখন যদি বসানো হয়, তাহলে তা খুব ভালো হবে।’

Comments
Comments