প্রতিনিধি মাদারীপুর
![]() |
নিখোঁজ তরুণদের সন্ধানে তাদের ছবি হাতে স্বজনেরা। গত ২২ জুলাই মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
অবৈধ পথে ইতালির উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ১৪ তরুণ। কিন্তু দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর পাঁচ মাস ধরে তাঁদের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। স্বজনদের দাবি, দালালের প্রলোভনে পড়ে জনপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণও দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু সন্ধান না পাওয়ায় চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা।
ইউরোপের কোনো দেশে গেলে সচ্ছলতা আসবে, এমন ধারণা নিয়ে প্রতিবছর মাদারীপুর থেকে শত শত তরুণ সেখানে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছেন। তবে অবৈধ পথে ইউরোপ যেতে গিয়ে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। কেউবা দালালের খপ্পরে পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে কাটাচ্ছেন বন্দিজীবন। জেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্য বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত জেলার ৪৫ জন লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে মারা গেছেন। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে লিবিয়া থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছেন অন্তত ৩৫০ তরুণ। নিখোঁজ আছেন তিন শতাধিক।
সবশেষ নিখোঁজ তরুণদের সবার বাড়ি রাজৈরের বাজিতপুর ইউনিয়নে। তাঁরা হলেন পাখুল্লা গ্রামের জাহাঙ্গীর ব্যাপারীর ছেলে সালমান ব্যাপারী, চৌরাশী গ্রামের মোসলেম শিকদারের ছেলে বাবুল শিকদার, একই গ্রামের মজিবর বয়াতীর ছেলে সাজ্জাদ বয়াতী, জাকির মাতুব্বরের ছেলে বাদল মাতুব্বর, কানাই রায়ের ছেলে লিটন রায়, নিরঞ্জন বাড়ৈর ছেলে বাঁধন বাড়ৈ, কিসমদ্দি বাজিতপুর গ্রামের আলম চৌকিদারের ছেলে ইমন চৌকিদার, অহিদুল মাতুব্বরের ছেলে নয়ন মাতুব্বর, আজিজ খালাসির ছেলে খলিল খালাসি, সোনা মিয়া চৌকিদারের ছেলে সোহেল চৌকিদার, নয়াকান্দি বাজিতপুর গ্রামের গৌরাঙ্গ বাড়ৈর ছেলে গৌতম বাড়ৈ, একই গ্রামের সামচু সরদারের ছেলে ইমরান সরদার, শ্রীনাথদী বাজিতপুরের জলিল বয়াতীর ছেলে আল আমিন বয়াতি ও শ্রীনদী গ্রামের সিদ্দিকুর রহমান ঘরামির ছেলে আলী ঘরামি। তাঁদের সবার বয়স ১৮ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে।
স্বজনদের অভিযোগ, মানব পাচার চক্রের সক্রিয় সদস্য বাজিতপুর এলাকার বাবুল হাওলাদার ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেক পরিবারের কাছ থেকে প্রথমে ১৬ লাখ টাকা করে নেন। পরে লিবিয়ায় বন্দী করে আদায় করেন আরও ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। এর পর থেকে ঘরে তালা ঝুলিয়ে পালিয়েছেন অভিযুক্ত বাবুল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
ভুক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই ১৪ তরুণ গত ফেব্রুয়ারি মাসে দালালের হাত ধরে ঘর ছাড়েন। তাঁরা প্রথমে ভ্রমণ ভিসায় দুবাইয়ে যান। সেখানে কয়েক দিন থেকে লিবিয়ায় পৌঁছান। সেখানে তাঁদের একটি বন্দিশালায় আটকে রেখে চুক্তির ১৬ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়। পরে তাঁদের লিবিয়ার মাফিয়াদের হাতে বন্দী দেখিয়ে আরও ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা জনপ্রতি আদায় করা হয়। এরপর ওই তরুণদের ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি নেওয়ার কথা থাকলেও ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকে তাঁদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। নিখোঁজ তরুণদের স্বজনেরা দালালের কাছে বারবার ধরনা দিলেও দালাল কৌশলে তাঁদের কয়েক দিন ঘুরিয়ে পরে লাপাত্তা হয়ে যান।
বাজিতপুর এলাকার আজিজ খালাসি বলেন, ‘দালাল বাবুল হাওলাদার জোর করে আমার কাছ থেকে ছেলের পাসপোর্ট নেয়। তখন বলেছিল, আমার ছেলেকে সুন্দর করে ইতালি পাঠাবে। কিন্তু লিবিয়ায় বন্দী করে প্রথমে ১৬ লাখ টাকা নেয়, তার চার মাস পর নেয় ৫ লাখ। তবু ক্ষান্ত হয়নি দালাল বাবুল, মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে আরও ১০ লাখ টাকা নেয়। এত টাকা দিলাম, তবু ওরা আমার ছেলেডারে ফিরাইয়া দিল না। ইতালিও পাঠাইল না। কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই জানি না। পুরো পথে বসে গেছি আমরা।’
জায়গাজমি বিক্রি করে ৩০ লাখ টাকা দালালকে দিয়েও ছেলে বাঁধন বাড়ৈর কোনো সন্ধান পাননি নিরঞ্জন বাড়ৈ। তিনি বলেন, ‘ছেলেকে লিবিয়ায় ভালোভাবেই নিছে। পরে দালাল চাপাচাপি শুরু করে। প্রথমে মাফিয়াগো হাতে ধরা খাইছে কইয়া নিছে ১০ লাখ, তারপর ৫ লাখ ও আবার ১৫ লাখ টাকা দিই। এসব টাকা সুদে ও জমি বিক্রি করে আনতে হইছে। টাকা দেওয়ার সবকিছু ভিডিও করা আছে। এখন আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। কার কাছে কী বিচার চামু? টাকাও গেল, পোলাডারও কোনো খবর পাইতাছি না।’
নিখোঁজ সোহেল চৌকিদারের স্ত্রী রুনা বেগম বলেন, ‘বাড়িতে যত জায়গা ছিল, সবকিছু বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা দালালের হাতে তুলে দিছি। সুদে টাকা এনেও দিছি। আমার স্বামীর খোঁজ নেই ৫ মাসের বেশি সময় ধরে। এখন না খেয়ে জীবন কাটাচ্ছি। আমার স্বামীর কোনো খোঁজই পাচ্ছি না। এখন আমাদের বেঁচে থাকার কোনো রাস্তা নেই।’
দালাল বাবুল হাওলাদার ছাড়াও তাঁর মেয়ে সোনিয়া আক্তার ও শশি আক্তার, বাবুলের স্ত্রী চুন্নু বেগম এ চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা। গত বুধবার বাবুল হাওলাদারের বাড়ি বাজিতপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ি তালাবদ্ধ। প্রতিবেশীরাও তাঁদের সন্ধান জানেন না। কেউ বলছেন, বাবুল পরিবার নিয়ে এখন ঢাকায় থাকেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, বিদেশে চলে গেছেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে কল দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর মেয়ে সোনিয়া আক্তার মুঠোফোনে বলেন, ‘আমার বাবা কারও টাকা নিয়ে পালায় নাই। তিনি তাঁর কাজ করেছেন। লিবিয়া নেওয়া পর্যন্ত তাঁর কাজ ছিল। এরপর তিনি কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি। লিবিয়াতে মাফিয়াদের হাতে ধরা পড়ার পর নিখোঁজ তরুণদের স্বজনেরা আমাদের কাছে আসে, তখন বাবা সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনো মুক্তিপণের টাকা বাবা নিজে বা আমরাও গ্রহণ করি নাই।’
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে মামলা করতে বলা হলেও কেউ তেমন আগ্রহী হননি বলে জানিয়েছেন রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুদ খান। তবে পুলিশ দালালদের বিষয় খোঁজখবর রাখছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজৈরে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়া, নিখোঁজ বা মৃত্যু নতুন কিছু নয়। কোনো এই অবৈধ যাত্রা বন্ধ করা যাচ্ছে না। এখনো থানার ৪০০ থেকে ৫০০ তরুণ ও যুবক লিবিয়ায় বন্দী। তাঁদের কেউ কেউ ইতালি যেতে পারলেও অনেকে বন্দিশালায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। সচেতন না হলে এই সমস্যা নির্মূল করা সম্ভব নয়।