নাদিম মাহমুদ

আমরা যাঁরা একাডেমিক গবেষণা করছি, তাঁরা সব সময় বিজ্ঞান সাময়িকী চর্চার মধ্যে থাকি। বলতে গেলে দিনের শুরুটা হয় এসব সাময়িকীতে কী কী গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হলো, কী কী ডেটা উপস্থাপন হচ্ছে, তার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রেখে।

এর কারণ হলো, অনেক সময় দেখা যায়, নিজেদের গবেষণার বিষয় পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তের গবেষকদের সঙ্গে ‘ওভারল্যাপ’ হয়ে যায়। তাই নিজেদের কাজগুলো এগিয়ে নিতে ও গবেষণার পদ্ধতি অনুসরণ করতে একাডেমিশিয়ানদের ‘বিজ্ঞান সাময়িকী’ চর্চার কোনো বিকল্প নেই।

২.

এসব সাময়িকী চর্চা করতে গেলে অধিকাংশ সংস্করণে আমরা কিছু গবেষণার সংশোধনী অথবা রিট্রাকশন দেখতে পাই। দেখা গেল, বেশ কয়েক বছর আগে এক ব্যক্তি গবেষণা করেছেন, তা প্রকাশিতও হয়েছে; কিন্তু পরবর্তী সময় অন্য কোনো গবেষক সেই গবেষণায় ভুল পান।

যদি শব্দগত ভুলের মাত্রা কম হয়, সে ক্ষেত্রে সেসব শব্দ সংশোধন করে ওই সাময়িকীর সম্পাদক বরাবর চিঠি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তা সংশোধনের জন্য নতুন ওয়েবসাইটের লিংক জার্নালগুলোয় পাঠকের কাছে তুলে ধরা হয় ‘কৈফিয়ত’ আকারে।

অন্যদিকে যদি গবেষণাপ্রবন্ধটিতে প্লেজিয়ারিজম হয়, অর্থাৎ অন্যের গবেষণার আইডিয়া, ডেটা কিংবা বাক্য হুবহু বা আংশিক কৃতিত্ব দেওয়া ছাড়া চুরি করা হয়, ঘষামাজা করা হয়; তাহলে সেটি একাডেমিক ‘ডিজইন্টেগ্রিটি’র মধ্যে পড়ে এবং সেই প্রবন্ধ প্রত্যাহার বা রিট্রাকশনের জন্য জার্নালগুলোয় আবেদন জানানো হয়।

পরবর্তী সময় বেশ কিছু ধাপ পেরিয়ে, জার্নালগুলো সেই প্রবন্ধ প্রত্যাহারের জন্য তাদের স্বীয় ওয়েবসাইটে নোটিশ দেয়, সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষকদের কৈফিয়তনামাও থাকে। এসব ভুলের জন্য একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলো নৈতিকতার দণ্ডে শাস্তি প্রদান করে।

এগুলোই হলো গবেষণাপ্রবন্ধ প্রকাশ ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষণার ভুলভ্রান্তি নিয়ে একাডেমিক নৈতিকতার সংক্ষিপ্ত আকারের আলোচনা। সারা দুনিয়ার গবেষকেরা এই ভিত্তির ওপর নির্ভর করে গবেষণা করে যাচ্ছেন এবং পৃথিবীকে জ্ঞানে সমৃদ্ধ করছেন।

৩.

একাডেমিক গবেষণাপ্রবন্ধ ও প্রতিদিনের সংবাদগুলোর মধ্যে মূল তফাত হলো ‘পাঠক’। একাডেমিক প্রকাশনাগুলোর টার্গেট অডিয়েন্স হচ্ছে গবেষক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। যে কারণে এসব প্রবন্ধের ভাষা ও শব্দশৈলী অনেকটাই পাঠ্যপুস্তকের ভাষার মতো হয়ে থাকে। কারণ, এসব গবেষণার নির্যাসই পাঠ্যবইয়ে চলে আসে।

অন্যদিকে সংবাদপত্র কিংবা সংবাদমাধ্যমগুলোর ভোক্তা হচ্ছেন সাধারণ পাঠক। এখানে সব শ্রেণির পাঠকদের মনোবৃত্তকে ধারণ করে সংবাদ তৈরি করা হয়, প্রকাশও করা হয়।

তাই সংবাদমাধ্যমগুলো সহজবোধ্য ও প্রাসঙ্গিক বাক্যে ঘটনাপ্রবাহ পাঠকদের জানায়। এটা জানাতে গিয়ে সংবাদকর্মীদের যেমন ঘটনাস্থলে থাকতে হচ্ছে, ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, ভুক্তভোগী, অভিযুক্ত বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করতে হচ্ছে, তেমনি দ্রুততার সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ ও নির্ভুল সংবাদ পরিবেশন করতে হচ্ছে।

এই পরিবেশনায় অনেক সময় দেখা যায়, সংবাদটিতে ‘তথ্যগত’ ভুল থাকছে কিংবা মূল ঘটনার সঙ্গে উপস্থাপনায় ত্রুটি থাকছে। পেশাদার সংবাদমাধ্যমগুলো যখনই সেই ভুল নিজেদের নজরে আনতে পারছে কিংবা পাঠক বা অন্য কোনো মাধ্যম থেকে জানতে পারছে যে পরিবেশিত সংবাদটিতে ত্রুটি আছে, তখন তা সংশোধন করে পুনরায় প্রকাশ করছে।

ছাপা পত্রিকায় কিছুটা ঝক্কিঝামেলা থাকলেও অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোয় সংবাদ সংশোধনের অবারিত সুযোগ থাকায়, সেই ভুলগুলো অনায়াসে সংশোধন করা যায়। তথ্যসচেতন পাঠকেরা মূল সংবাদ উত্থাপনের সময় আর সর্বশেষ ‘আপডেট করার সময়’ মিলিয়ে বুঝতে পারেন সংবাদটি কখন সংশোধিত কিংবা সম্পূর্ণ আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। অনলাইন গণমাধ্যমগুলো এভাবে চলছে।

তবে এসব পরিবেশিত সংবাদের বিষয়ে যদি ‘গুরুতর’ ত্রুটি থেকে যায় কিংবা কেউ অভিযোগ করে যে সংবাদটি ভুল কিংবা মিথ্যা পরিবেশিত হয়েছে, তাহলে দায়িত্বশীল গণমাধ্যমগুলো সেই সংবাদ সংশোধনের পাশাপাশি একটি ‘এডিটরিয়াল নোট’ বা সম্পাদকীয় বক্তব্য জুড়ে দেয়, যাতে পরবর্তী সময়ে যে পাঠক সংবাদটি পড়বেন, তিনি সংবাদটির বিষয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ বুঝতে সক্ষম হবেন।

৪.

প্রচলিত এই চর্চার ভিড়ে অনেক সময় আমরা দেখতে পাই, পাঠকদের অন্ধকারে রেখেই সংবাদমাধ্যমগুলো হরহামেশা সংবাদ উধাও করে ফেলছে। সংবাদটি কেন প্রত্যাহার করা হচ্ছে, তার কোনো ব্যাখ্যা কিংবা বিশ্লেষণ সেসব সংবাদমাধ্যম থেকে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে ‘এডিটরিয়াল ডিজঅনেস্টি’ বা ‘সম্পাদকীয় অসততা’ সাধারণ পাঠকদের সেই গণমাধ্যমের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দিতে পারে।

এখনকার সংবাদমাধ্যমগুলো যেহেতু মূল ওয়েবসাইটে সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিংকগুলো শেয়ার করে, তাই সেখানে মূল সংবাদের শিরোনাম ও ছবি শোভা পেলেও পরবর্তী সময় পাঠকেরা ওই লিংকে ঢুকলে ‘৪০৪ পেজ নট ফাউন্ড’ দেখতে পান। অর্থাৎ পাঠকদের ধোঁকা দিয়ে সেই লিংকের সংবাদ সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যম সরিয়ে ফেলেছে, যা নৈতিক সাংবাদিকতার বড় বাধা।

৫.

সম্প্রতি প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) একটি অনুষ্ঠানে এ রকম কিছু অভিযোগ তুলেছেন সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটি) একটি প্রকল্পের একজন পরামর্শক। তিনি তাঁর ‘অসম্পূর্ণ’ গবেষণায় দাবি করেছেন, বাংলাদেশ থেকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত একটি দৈনিক সংবাদপত্র ১২১টি ‘ফেক নিউজ’ বা ‘ভুয়া সংবাদ’ প্রত্যাহার করেছে।

পাঠক মনে রাখবেন, ওই গবেষক ‘ফেক’ বা ‘ভুয়া’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি সেখানে এই সংবাদপত্রের  পাশাপাশি আরও কিছু গণমাধ্যমের উদাহরণ টেনেছেন; পরবর্তী সময়ে যদিও এক বিবৃতিতে পিআইবি একে ‘বিভ্রান্তি’ তৈরি হয়েছে বলে দাবি করেছে। পিআইবি যে দাবিই করুক না কেন, পুরো বিষয়টা একটা গুরুতর ভুল।

সংবাদ সরিয়ে নেওয়া, সংবাদ সংশোধন করা, সংবাদে অপতথ্য বা ভুয়া তথ্য সংযোজনের অভিযোগগুলোর তফাত আমাদের জানা থাকা প্রয়োজন। গবেষণার কর্মপদ্ধতি ও ডেটা কিউরেশনের নিয়ম কী, তা নিয়ে একাডেমিক আলোচনা হতেই পারে। তবে কোনো গবেষক যদি ডেডলিংক কিংবা ওয়েবসাইটের ‘৪০৪’ বার্তাকে ‘অপতথ্য’ কিংবা ‘ভুয়া তথ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করে, সেটি হবে মারাত্মক কিংবা আত্মঘাতী ভুল। 

কারণ, শুধু একটি লিংকে ঢুকতে না পেরে কেউ যদি মনে করেন যে সংবাদটি ভুল ছিল কিংবা চাপে পড়ে প্রত্যাহার করা হয়েছে, তাহলে সেটিকে কখনোই ‘জাজমেন্টাল এলিমেন্ট’ হিসেবে ধরা সম্ভব নয়। কারণ, তিনি সেই সংবাদ খোঁজার জন্য দ্বিতীয় কোনো কর্মপন্থা অবলম্বন করেছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন জাগবে।

বর্তমানে সংবাদমাধ্যমগুলোর সার্চ অপশনে কিংবা গুগলে বাংলায় সেই সংবাদের শিরোনামের কয়েকটি শব্দ কিংবা পত্রিকার নাম দিয়ে খোঁজ করলে, সেই সংবাদটি আপনা–আপনি চলে আসার কথা। সংশ্লিষ্ট গবেষক কি এ ধরনের চেষ্টা করেছেন?

সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন এখানে, তা হলো, গবেষক যদি মনে করেনই তিনি ‘ডেডলিংক’-এ প্রবেশ করতে পারছেন না, তাহলে তিনি সংবাদটি কীভাবে পড়লেন? আর যদি সংবাদটি না পড়তে পারেন, তাহলে তিনি কীভাবে উপসংহার টানলেন যে সংবাদটি ‘ভুয়া’ কিংবা ‘অপতথ্য’ ছিল?

এসব বিশ্লেষণের সুযোগ তিনি আদৌ পেয়েছেন কি না, জানি না। তবে নৈতিকতার মানদণ্ডে অটুট থাকা গবেষকদের উচিত হবে, এসব সংবাদের গুরুত্ব ও পরিধি বিবেচনা করা।

এখানে পরিধি বলছি এই কারণে, যদি কোনো সংবাদমাধ্যম বিশেষ কোনো সংবাদ প্রত্যাহার করে, তাহলে সেই সংবাদের বিষয়ে গণমাধ্যমকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়। কিন্তু সেসব সংবাদ যদি সর্বজনীন অর্থাৎ অন্য কোনো গণমাধ্যমে পাওয়া যায়, তাহলে অনেকটাই অনুমেয় যে সেই সংবাদ অবশ্যই সেই গণমাধ্যমেও প্রকাশ করা হয়েছে। সেটি যদি হয় সংবাদপত্রটি, তাহলে মনে রাখতে হবে, তারাও সেটি প্রকাশ করার সক্ষমতা রাখে।

৬.

শেখ হাসিনা সরকারের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে যারা বছরের পর বছর বস্তুনিষ্ঠ ও সাহসী সাংবাদিকতা করে আসছে, সেই ধরনের কোনো গণমাধ্যমকে সংবাদ প্রত্যাহারের শীর্ষে থাকার দাবি করা অনেকটাই হাস্যকর।

আমি হাস্যকর বলছি এ কারণে যে বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম যদি ছয় মাসে ১২১টি কনটেন্ট সরিয়ে ফেলে, তাহলে দেশের অন্য সংবাদমাধ্যমগুলোর ক্ষেত্রে এ সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার কথা। কারণ, এই সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে কেউ কেউ নিত্যদিনই সংবাদ তোলে এবং খেয়ালখুশিমতো প্রত্যাহারও করে। সেই সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই সংবাদপত্রকে ছাড়িয়ে যাবে।

সংবাদপত্রটি সংশোধনী দিলে দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে এর একটি ব্যাখ্যা দেয়, যা অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে বিরল। এ অবস্থায় সংবাদপত্রটির  বিরুদ্ধে ছয় মাসে সংবাদ প্রত্যাহারের শীর্ষে থাকার অভিযোগটি কেবল একাডেমিকভাবেই সিদ্ধ নয়, এটি বাস্তবতার নিরিখে অসম্ভব। কারণ, এর মানে প্রতি মাসে গড়ে পত্রিকাটিকে ২০টি খবর প্রত্যাহার করতে হয়েছে; এটা যেকোনো সচেতন পাঠকের চোখে পড়ার কথা।

৭.

হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে গণমাধ্যমগুলো পাঠকদের প্রতি দায়বদ্ধতা অনেকটাই হারিয়ে ফেলছে। অনেক গণমাধ্যমই সংবাদের সংশোধন কিংবা প্রত্যাহারের ‘কৈফিয়ত’ দেওয়ার মতো দায়িত্বশীলতা দেখায় না। এ কারণে গণমাধ্যমগুলোর প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সাধারণ পাঠকদের মনে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, যা প্রত্যাশিত নয়।

সব ধরনের কাজের ক্ষেত্রেই ভুল হতে পারে, ভুল সংশোধনের সুযোগও রয়েছে। ভুল সংশোধনের যে সুযোগ ও দায়বদ্ধতা রয়েছে, সংবাদমাধ্যমগুলোকে পুরোপুরি অনুসরণ করতে হবে।

একটি কথার পুনরাবৃত্তি দিয়ে শেষ করি: দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যমের উচিত হবে যেকোনো সংবাদ প্রত্যাহার করলে পাঠকদের জন্য সম্পাদকীয় নোট দেওয়া। ফলে সংবাদটির প্রতি যেমন পাঠকদের স্বচ্ছতা তৈরি হয়, তেমনি সেই গণমাধ্যমের প্রতিও আস্থা বাড়ে।

● লেখক: গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)