প্রতিনিধি ভোলা
![]() |
এখনো জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে ভোলার শিবপুর ও ধনিয়া ইউনিয়নের বাঁধের বাইরের লোকালয়, খেত, বাগান আর জলাশয়। মঙ্গলবার বিকেলে সদর উপজেলার শিবপুর কালিকীর্তি গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
বৃষ্টির সঙ্গে উঁচু জোয়ারে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে ভোলার মানুষ। সদর উপজেলার শিবপুর-ধনিয়া ইউনিয়নের বন্যা-জলোচ্ছ্বাস রক্ষাবাঁধের বাইরে অনেক ভিটেবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। অনেকে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। এক সপ্তাহ ধরে চলছে এ পরিস্থিতি। প্রতিনিয়ত বড় আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন ভুক্তভোগী বাসিন্দারা।
শিবপুর ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের কালিকীর্তি গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম (৩২)। তিনি জানান, গত বৃহস্পতিবার থেকে দিনের জোয়ারে পানি উঠে বাড়ির উঠান, পুকুর, বাগান, এমনকি বসতঘরের ভেতর পানি ঢুকতে শুরু করে। পানি ওঠার পরে চার–পাঁচ ঘণ্টা থাকে। পরে আস্তে আস্তে নামতে থাকে। বৃহস্পতি, শুক্র, শনিবার একই রকম দুপুরের পরে জোয়ারের পানি ঘরে উঠেছে। রোববার থেকে জোয়ারের উচ্চতা কমতে থাকে। তা–ও বাড়ির উঠান ডুবে যায়, সঙ্গে আছে বৃষ্টি। গতকাল মঙ্গলবার বাড়ি, রাস্তাঘাট, পুকুর-বাগান সব ডুবে যায়। রাতের জোয়ারের উচ্চতা কম থাকে, নইলে বিপদের শেষ ছিল না।
আবুল কালামের মতো ভোলার সদর উপজেলার শিবপুর-ধনিয়া ইউনিয়নের বন্যা-জলোচ্ছ্বাস রক্ষাবাঁধের বাইরে বসবাস করা প্রায় ৭০০ পরিবার জোয়ারের পানিতে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। তারা এ সমস্যার সমাধানে সরকারের কাছে দ্রুত প্রকল্প গ্রহণের দাবি জানায়।
বিষয়টি নজরে আনা হলে ভোলার জেলা প্রশাসক আজাদ জাহান বলেন, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্তদের উন্নয়নের জন্য কোনো প্রকল্প নেওয়ার আগে প্লাবিত অঞ্চল পরিদর্শন করতে হবে। আপাতত তাঁদের জন্য খাদ্যসহায়তা দেওয়ার চিন্তা আছে।
মঙ্গলবার সরেজমিন দেখা যায়, দিনভর থেকে থেকে বৃষ্টির সঙ্গে যোগ হয়েছে জোয়ারের পানি। তাই রাস্তাঘাট, উঠান সর্বত্র কর্দমাক্ত। পানি নামতে না নামতেই আবার পানি উঠছে। মাটির ঘরের ভিটায় পলিথিন, প্লাস্টিক, জালকাটা, জিওটেক্সটাইলের বস্তাসহ নানা জিনিস দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে, পানির ঝাপটায় তারপরও ক্ষতি হয়েছে। গাছের শিকড় বেরিয়ে পড়েছে। বাঁধের তীর ক্ষয়ে গেছে। নদীর তীরে ফেলা বালুভর্তি জিও ব্যাগ সরে যাচ্ছে। বেড়েছে ভাঙনের তীব্রতা।
![]() |
ওঠা উচ্চ জোয়ারে ভেঙে যাচ্ছে বন্যা-জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। শঙ্কিত মানুষ। মঙ্গলবার বিকেলে ভোলার সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের ভোলাখালের মাথা এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
জোয়ার আর তীব্র ঢেউয়ের আঘাতে বিভিন্ন জায়গায় ভাঙন দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি ভেঙেছে ভোলা খালের মাথা মাছঘাট এলাকা। এখানে মাছ কেনাবেচার আড়তদারের স্থাপনা, সামনের রাস্তাঘাট, সেতু ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। মাছঘাটের অন্য পাশে ভাঙনে ভোলা খালের তীর নদী হয়ে যাচ্ছে। গাছপালা ভেঙে পড়েছে। বস্তা ফেলা হচ্ছে ভাঙন প্রতিরোধে, তাতেও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। আগে কালিকীর্তি গ্রামের ভাঙনের মুখে বস্তা ফেলেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড, তা ভেঙে গেছে। বাঁধের বাইরে তাকালে দেখা যায়, পানি আর পানি।
কৃষকেরা জানান, এসব পানির নিচে আমনের খেত, সবজিখেত, আমনের বীজতলা, মাছের পুকুর, সুপারির বাগান সব জোয়ারের পানিতে ডুবে আছে। ভাটায় আবার জেগে উঠবে। তখন বোঝা যাবে আসল চিত্র। জোয়ারের সময় সবটুকুই নদী মনে হয়।
ভুক্তভোগী বাসিন্দারা জানায়,
শিবপুরের এক নম্বর, দুই নম্বর ওয়ার্ডে শতাধিক পরিবার এবং ধনিয়া ইউনিয়নের ৭
নম্বর ওয়ার্ডের বলরামসুরা গ্রাম ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের গঙ্গাকীর্তি গ্রামের
পাঁচ শতাধিক পরিবার জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। অনেকে নিজস্ব উদ্যোগে
রিংবাঁধ দিয়ে পানি থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে; তবে তা ব্যর্থ হচ্ছে।
ধনিয়া
ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বলরামসুরা গ্রামের বাসিন্দা সৈয়দ আহাম্মেদ
ভুঁইয়া বলেন, ‘গত ৫০ বছরে তিনবার ভাঙনে নিঃস্ব হয়েছি। আবার ভাঙন তাড়া করছে।
মনে হয় বেশি দিন থাকতে পারব না। জোয়ার এখন বাঁধ উপচে পড়ছে।’
শিবপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম, মো. জিহাদ, মো. ফিরোজসহ একাধিক বাসিন্দা জানান, ইউনিয়নের প্রধান বন্যা-জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে একটি রিংবাঁধ আছে। সবার সহযোগিতায় ১৫ বছর আগে প্রায় দেড় কিলোমিটার লম্বা এই রিংবাঁধ দেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এই রিংবাঁধের মধ্যে প্রায় ৩৫০ পরিবার বসবাস করছে। আছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মসজিদ। গত কয়েক দিনের উচ্চ জোয়ারের ঢেউ আছড়ে পড়ে দেড় কিলোমিটার রিংবাঁধের বেশির ভাগই ঝুঁকিতে পড়েছে।
মঙ্গলবার বিকেলে দেখা যায়, রিংবাঁধের আওতায় বসবাস করা মানুষজন নিজ উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের কিছু অংশে বস্তা ও মাটি ফেলে সংস্কার করেছে। তারপরও বেশির ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত ঝুঁকিতে পড়ে আছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আগামী পূর্ণিমার আগে বাকি অংশ সংস্কার না করলে ওই বাঁধ ছুটে রিংবাঁধের মধ্যে পানি ঢুকতে পারে। যদি পানি ঢোকা শুরু হয়, তখন তাঁরাও নিয়মিত প্লাবিত হবেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড যদি এ রিংবাঁধের ওপর জরুরি ভিত্তিতে বালুভর্তি বস্তা না ফেলে, তাহলে মানুষের ক্ষতির শেষ থাকবে না। বিদ্যালয়টিও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. হাসানুজ্জামান বলেন, তাঁরা মূল বাঁধের বাইরে কোনো বাঁধের উন্নয়ন করেন না। শিবপুর কালিকীর্তির ওই রিংবাঁধ তাঁরা সংস্কার করতে পারবেন না। তবে ভাঙন প্রতিরোধে একটি প্রকল্প ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সেটি যদি পাস হয়, তখন তীর সংরক্ষণ করা হবে।