নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা
ইয়াছিন মজুমদার ও আকলিমা আকতার দম্পতির পাঁচ মেয়ে। তাদের মধ্যে সারিনাহ জাহান (ছায়রা) ও সাইবাহ জাহান (সায়মা) যমজ এবং সবার ছোট। পরিবারের সবচেয়ে আদরের মেয়ে দুটির দিন কাটছে এখন সবচেয়ে কষ্টে। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে তারা। বাড়ি নিয়ে যাওয়ার আবদার জানিয়ে তারা মা-বাবাকে বলছে, বুক ধড়ফড় করে তাদের। ভয় লাগে।
১০ বছর বয়সী এই দুই বোন রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের (কাকাতুয়া সেকশন) চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। গত সোমবার স্কুলটির একটি ভবনে আছড়ে পড়ে যুদ্ধবিমান। এতে সারিনাহ ও সাইবাহও দগ্ধ হয়েছে।
জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাশাপাশি বিছানায় ভর্তি আছে এই যমজ। চিকিৎসকেরা যে তালিকা টাঙিয়েছেন, সে অনুযায়ী সারিনাহর শরীরের ৩০ শতাংশ এবং সাইবাহর ১৫ শতাংশ পুড়েছে।
ইয়াছিন মজুমদার জানালেন, হাসপাতালে মেয়েদের থাকতে ভালো লাগছে না। ভয় পাচ্ছে। যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাঁদে। দ্রুত বাড়ি ফিরতে চায়। তবে কবে নাগাদ দুই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন, সে ব্যাপারে চিকিৎসকেরা কিছু বলেননি।
সারিনাহ ও সাইবাহর দুই হাত, দুই পা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। পিঠ, মুখসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গা ঝলসে গেছে দুই বোনের।
ইয়াছিন বললেন, আজ (গতকাল) দুই মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতে হয়েছে। সিঙ্গাপুর থেকে আসা চিকিৎসকেরা দুই মেয়েকে দেখেছেন। অনেকগুলো টেস্ট (পরীক্ষা) দিয়েছেন। স্কুলের শিক্ষক ও বিমানবাহিনীর একটি প্রতিনিধিদলও হাসপাতালে এসেছিল।
ড্রেসিংসহ অন্যান্য যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে দুই মেয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে উল্লেখ করে ইয়াছিন বলেন, সেই দিনের বীভৎসতার স্মৃতি তো আছেই। মেয়েরা শুধু বলে, বুক ধড়ফড় করে। ভয় লাগে। তবে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার দিনের কথা কিছু বলে না বা এ নিয়ে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় না বলে জানালেন এই বাবা।
ছায়রা ও সায়মাকে দেওয়া হচ্ছে তরল খাবার, ডিমের সাদা অংশ।
মা আকলিমার চোখের সামনেই সেদিন বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। মেয়েদের মতো তিনিও সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারছেন না। আকলিমাকেও খুঁজে পেতে দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায় বলে জানালেন ইয়াছিন।
সোমবারের পর থেকে এই দম্পতি একবারের জন্যও বাসায় যেতে পারেননি। বার্ন ইনস্টিটিউটে আকলিমা একটি টুলে মেয়েদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে বসে থাকেন। সময়ে সময়ে খাবার খাইয়ে দেন। ইয়াছিন সেখানে ঢুকতে পারেন না, ইনস্টিটিউটের এ জায়গায় সে জায়গায় দিন-রাত পার করছেন।
রাজধানীতে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কাছেই পরিবার নিয়ে থাকেন ইয়াছিন। তবে ঘটনার দিন তিনি ঢাকায় ছিলেন না, ছিলেন চট্টগ্রামে। ঘটনা শোনার পর তিনি ঢাকায় রওনা দেন। মেজ মেয়ে ফোনে ইয়াছিনকে ঘটনার কথা জানায়। মাকে ফোনে পাচ্ছে না বলেও জানিয়েছিল।
সেদিনের বর্ণনায় আকলিমা বললেন, মেয়েদের স্কুল ছুটি হয় বেলা একটায়। স্কুলের গেটের কাছে যাওয়ার একটু আগেই প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পান। কালো ধোঁয়া দেখতে পান। এরপর চারপাশে শুধু আগুন আর আগুন।
‘দগ্ধ হওয়া বাচ্চাদের বের করছেন উদ্ধারকর্মীরা। অনেক বাচ্চার শরীরে চামড়া পর্যন্ত নেই। কারও কারও জামাকাপড় পুড়ে যাওয়ায় উলঙ্গ অবস্থায় বের করা হয়। আমি খুঁজি আমার দুই মেয়েকে। মেয়েদের তো আর পাই না। এই দিক ওই দিক দৌড়াই’, বললেন আকলিমা।
ঘটনার পরপর আকলিমার সঙ্গে পরিবারের কেউ যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। পরে আকলিমা নিজেই বড় মেয়েকে ফোন করেন। আকলিমা খবর পান, মেয়েদের উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আকলিমা হাসপাতালে ছুটে যান। স্কুল থেকে ইয়াছিনকেও ফোন করে হাসপাতালে মেয়েদের নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। ইয়াছিনের এক আত্মীয় ইসমাইল মজুমদার হাসপাতালে গিয়ে সাইবাহ ও তাঁর মাকে পান। তবে সেখানে সারিনাহকে পাওয়া যায় না। সেখান থেকে পরে বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয় সাইবাহকে। এখানে আসার পর সারিনাহকে পাওয়া যায়।
এই যমজ বোনের জন্ম ২০১০ সালের ২ জানুয়ারি। ইয়াছিন-আকলিমা দম্পতির অন্য তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। আরেক মেয়ে মাইলস্টোন স্কুল থেকেই এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তির অপেক্ষায় আছে।
ইয়াছিন বললেন, ‘দুই মেয়েকে নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরতে পারব, চিকিৎসকেরা তা নিয়ে আশাবাদী। তবে নিজের দুই মেয়ে এবং অন্য বাচ্চাদের কষ্ট দেখে মন খুব খারাপ।’