নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা

একটি অসুস্থ কুকুরকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করছেন তাওহিদুর রহমান ও সিয়াম চৌধুরী নামের দুই তরুণ। গত শনিবার দুপুরে মিরপুর-১০ নম্বরে  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন  

পথের পাশের কুকুর-বিড়ালের প্রতি রাজধানীর মানুষের নিষ্ঠুরতার খবর প্রায়ই পাওয়া যায়। পা ভেঙে দেওয়া, গরম পানি দিয়ে শরীর পুড়িয়ে দেওয়া; এমনকি মানুষের মার খেতে খেতে কুকুর-বিড়ালের প্রাণ হারানোর ঘটনা এই শহরেই ঘটেছে প্রকাশ্যে। অবশ্য এর মধ্যে ব্যতিক্রমও আছে।

গত শনিবার দুপুরে মিরপুর-১০ নম্বর সংযোগ সড়কের পাশে দেখা যায়, একটি অসুস্থ কুকুরকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করছেন তাওহিদুর রহমান বৃত্ত ও সিয়াম চৌধুরী নামের দুই তরুণ। একজন অসুস্থ কুকুরটিকে কোলে তুলে নিয়ে স্যালাইন পুশ করছেন। আরেকজন একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় ধরে রেখেছেন স্যালাইনের ব্যাগটি। রোদ ও গরম উপেক্ষা করে কষ্টসাধ্য কাজটি দুই তরুণ মিলে করছিলেন পরম মমতায়।

কথা হয় শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির শিক্ষার্থী তাওহিদুর রহমান বৃত্তর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কুকুরটি নিউরো সমস্যায় ভুগছে। মুখের ভেতরেও জখম রয়েছে। পশুর চিকিৎসক আবদুর রহমানের পরামর্শমতো আমরা দুজন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কুকুরটিকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করছি। আমরা মনে করি, এই শহরটা শুধু মানুষের নয়। কুকুর, বিড়াল, ফুল, পাখি-প্রজাপতি যদি এই শহর থেকে বিলুপ্ত হয়, তাহলে মানুষ কখনো ভালো থাকতে পারবে না।’

রাকিবুল ও সিয়ামের মতো অসংখ্য পশুপ্রেমী তরুণ-তরুণী সারা শহরেই ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছেন। এঁদের কেউ পথের এই পশুদের নিয়মিত খাওয়ানোর দায়িত্ব নেন, কেউবা অসুস্থ কুকুর-বিড়ালকে সুস্থ করে পরিবারের সদস্য করে নেন।

দেশে করোনা মহামারি চলার সময় দোকানপাট, রেস্তোরাঁ বন্ধ ছিল। ঢাকার অলিগলির কুকুর–বিড়ালের খাওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ছিলেন চিকিৎসক রাফিয়া আলম। তিনি বলেন, ‘আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে ফরিদপুর নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটে। প্রাণ-প্রকৃতির কাছাকাছি থাকায় পশুপাখির প্রতি সহজাত মমতা শৈশব থেকে আমার মধ্যে কাজ করেছে। করোনার সময় কুকুর-বিড়ালের খাদ্যসংকট, তাদের নিদারুণ কষ্ট আমাকে স্পর্শ করে। সেই সময় বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতায় আমি কুকুর-বিড়ালদের নিয়মিত খাবার দিয়েছি। এখন চাকরি ও লেখালেখির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছি। সময় বের করা কঠিন। এরপরও আমি সপ্তাহে তিন দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে যাই। সারমেয়দের খাবার দিয়ে আসি।’

এদিকে অসুস্থ কুকুর-বিড়ালদের সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে চিকিৎসা নিশ্চিত করার কাজটি কৈশোর থেকেই শুরু করছিলেন রাকিবুল হক। সময়ের পরিক্রমায় প্রাণীর অধিকার রক্ষায় দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকের ভূমিকা পালন করছেন তিনি। সমমনা বন্ধুদের নিয়ে ২০১৫ চালু করেন পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন (প–ফাউন্ডেশন)। অসুস্থ-আঘাতপ্রাপ্ত বেওয়ারিশ প্রাণী উদ্ধার, চিকিৎসা ও আশ্রয়দান করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। ঢাকার বিরুলিয়া এলাকায় রয়েছে তাঁদের নিজস্ব উদ্ধারকেন্দ্র। স্বেচ্ছাসেবী এই সংগঠনটির লালমাটিয়া, মিরপুর ও উত্তরা এলাকায় রয়েছে ‘প লাইফ কেয়ার’ নামে তিনটি প্রাণী চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র। 

প্রাণী অধিকারকর্মী ও স্থপতি রাকিবুল হক বলেন, ‘পৃথিবীর সব প্রাণীর সুখ-দুঃখ নৈতিকভাবে সমান গুরুত্ব পাওয়া দরকার। এই বোধ আমাদের সমাজ থেকে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা সাংগঠনিকভাবে প্রাণীদের কল্যাণে কাজ করার চেষ্টা করছি। অনেকেই আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। আমরা বিশ্বাস করি, প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা না থাকলে মানুষ হওয়া যায় না।’