লেখা: এমরান হোসেন, নোয়াখালী

এখানেই ছিল আমাদের বাড়ি ছবি: লেখক

হাতিয়ার তমরদ্দি বাজারের কাছেই ছিল আমাদের বাড়ি। হেঁটে বাড়ি থেকে নদীর পাড়ে যেতে ঘণ্টাখানেক লাগত। কিন্তু বড় হতে হতে দেখলাম মেঘনা নিজেই আমাদের বাড়ির কাছে চলে এসেছে! একসময় এলাকার সবাই বুঝে ফেলল কিছুদিনের মধ্যেই নদীটা গিলে খাবে তাদের ভিটেমাটি। আমার বাবাও উপায়ান্তর না দেখে নতুন জায়গা খোঁজা শুরু করলেন। তখন সুবর্ণচর লাগোয়া হাতিয়ার মূল ভূখণ্ডে সদ্য একটা চর জেগে উঠছে। ২০০৫ সালে নতুন চরে একখণ্ড জায়গা নিলেন বাবা। বছর চারেক পরে আদি ভিটা ছেড়ে আমরা একেবারে স্থানান্তরিত হলাম নতুন চরে, নতুন ভিটায়।

তখন আমি সদ্য এইচএসসি পাস করা তরুণ। জন্মভিটা, ছোটবেলার বন্ধু, আত্মীয়স্বজন, উঠানভরা স্মৃতি ছেড়ে যেতে অনেক কষ্ট হয়েছিল। তবু বুকে স্বপ্ন নিয়ে নতুন জায়গায় গেলাম। নতুন মানুষদের আপন করে নিতে থাকলাম। চরে আরও অনেক নদীভাঙা মানুষ এসে বসত গড়ল। দুঃখে–সুখে আমরা আপন হলাম।

নতুন বাড়ি থেকে নদী প্রায় ১৫ কিলোমিটার। কিন্তু বছর পাঁচেক যাওয়ার পরই সেই চরেও শুরু হলো ভাঙন। গত বছর নদীর ভাঙন এসে থামল আমাদের বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে। এই নতুন চরে মানুষগুলো নতুন জীবন শুরু করেছিল। তাদের ঘরে তেমন একটা অভাবও ছিল না। প্রত্যেকের ছিল চাষের জায়গা, নিজস্ব পুকুর এবং বড় বাড়ি। কিন্তু মানুষগুলো আজ অন্যের জায়গায় মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমরাও আবার নতুন জায়গার খোঁজে ছোটাছুটি শুরু করলাম। পেলামও একটা জায়গা। ভাঙন শুরুর আগে সেখানেই চলে গেলাম। এটাই যেন চরের মানুষের নিয়তি।

এ মাসে নদী আমাদের বাড়িটা ভেঙেছে। ভিটার সঙ্গে শেষ হয়ে গেল আমার বাবার সারা জীবনের অর্জিত সম্পদ। আমাদের শেষ হয়ে গেল হাজারো জমানো স্মৃতি। সদ্য হারানো বাড়িতে আমি নতুন জীবনের শুরু করেছি, কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছি। আমাদের হাজারো দুঃখ–কষ্টের জীবন্ত সাক্ষী আজ নদীগর্ভে।