জীবনযাপন প্রতিবেদক ঢাকা

সারা পৃথিবীর অর্থনীতিই এখন বেশ ঘটনাবহুল। এক দেশ আরেক দেশের ওপর কড়া শুল্ক আরোপ করছে। মূল‍্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নেওয়া হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোগ। আমাদের দেশও নানা অর্থনৈতিক চ‍্যালেঞ্জের মধ‍্য দিয়ে যাচ্ছে। এ সময় অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের করণীয় কী? সামনের দিনগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চাইলে কীভাবে তৈরি হওয়া উচিত? এসব প্রসঙ্গেই আমরা কথা বলেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক রুবাইয়া মোরশেদ–এর সঙ্গে। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার অর্থনৈতিক দিক নিয়ে পিএইচডি করছেন তিনি।

মডেল: নুসরাত হিয়া | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, তখন অর্থনীতির বিভিন্ন প্রচলিত তত্ত্ব ও নিয়ম নিয়েই বেশি পড়তে হয়েছে। সাম্প্রতিক বাস্তবতায় এসব ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন বিহেভিয়রাল ইকোনমিকস নিয়ে পড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। অর্থনীতি নিয়ে যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের জন‍্য সামনের দিনগুলোয় কাজ ও গবেষণার সুযোগ আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করি। আমার যেমন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আগ্রহ। অর্থনীতিতে পড়েছি বলে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা কেমন, তার ভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে ভাবনার সুযোগ পাচ্ছি। এখন বিশ্বব্যাপী ব্যবসা ও অর্থনীতির বৈশ্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নীতিমালার পরিবর্তন, প্রযুক্তির অগ্রগতি, সবই অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার, ব্লকচেইন, বিগ ডেটা আর বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতিমালার বিভিন্ন পরিবর্তন নতুন ধরনের গবেষণা ও কাজের সুযোগ তৈরি করছে। বাংলাদেশেও এসব প্রযুক্তির প্রভাব পড়ছে। এসব বিষয়ে কাজের জন্য অনেক অর্থনীতিবিদ ও গবেষক প্রয়োজন। এখন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকে শুরু করে প্রকৌশলেও অর্থনীতি নিয়ে পড়তে হয়। কারণ, অর্থনীতি আমাদের বিভিন্ন দিক থেকে যেকোনো বিষয় নিয়ে ‘ক্রিটিক্যালি’ ভাবতে শেখায় এবং সব ক্ষেত্রেই আসলে অর্থনীতির সংযোগ আছে। তবে আমি শিক্ষক হিসেবে বলব, শুধু তাত্ত্বিক অর্থনীতি পড়লেই হবে না। আমাদের অর্থনীতিবিদদের এই নতুন যুগে চলতে গেলে মানবমনকে বুঝতে হবে, প্রচলন বুঝতে হবে এবং এ জন্য সাহিত্য, ইতিহাস ও আমজনতার সঙ্গে সংযোগ থাকতে হবে। অঙ্কে পারদর্শী হওয়ার পাশাপাশি আশপাশকে দেখা, চেনা ও জানার উদ্যোগ ও মানসিকতা থাকতে হবে।

আসছে বাজেট

বাংলাদেশে মে, জুন ও জুলাইয়ে বাজেট নিয়ে প্রতিবছর অনেক হইচই হয়। অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের জন‍্য বাজেট নিয়ে জানা ও গবেষণা একটা বড় সুযোগ হতে পারে। বাজেটবিষয়ক গবেষণার মাধ্যমে সরকারের নীতিমালা, রাজস্ব ও ব্যয়ের ভাগ, সামাজিক নিরাপত্তা খাত, অবকাঠামো উন্নয়ন ও কৃষি খাত, নানা দিক বিশ্লেষণ করা যায়। এই সময়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে গবেষণাপত্র লিখতে পারেন, পত্রিকায় লেখা পাঠাতে পারেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করা ও বাজেটের বাস্তবিক প্রভাব নিয়ে গবেষণা করা তরুণ অর্থনীতিবিদদের জন্য একটি বড় সুযোগ। মোটকথা, অর্থনীতি পড়ে দেশের জন্য ভালো কিছু করার সঙ্গে বাজেটের একটা অন্তরঙ্গ যোগসূত্র আছে। এ জন্য বাজেট প্রণয়নের পদ্ধতি বুঝতে পারা জরুরি। প্রশ্ন করা জরুরি, চিন্তা করা জরুরি ও নতুন প্রজন্মের অর্থনীতিবিদদের গবেষণা বা চিন্তা নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেওয়া জরুরি। এতে ওদেরও আগ্রহ বাড়বে।

গবেষণার নানা সুযোগ

বাংলাদেশের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো দারিদ্র্য ও অসচ্ছলতা। এটি মোকাবিলা করতে সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি অলাভজনক সংস্থা নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা এসব বিষয়ে বিশ্লেষণমূলক গবেষণা করতে পারেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এসব বিষয়ে গবেষণার লোক খোঁজা হচ্ছে। বাংলাদেশের রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ানোর জন‍্য কী করা যায়, তা নিয়েও গবেষণা হতে পারে। দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি এখনো শক্তিশালীভাবে ভূমিকা রাখছে। কৃষি খাতের প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক; তাই কৃষি নীতি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও কৃষকদের জীবনমান নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া দেশের এসএমই খাতসহ বিভিন্ন বিষয়ে অর্থনীতিপড়ুয়াদের গবেষণার সুযোগ দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত তো আছেই—উভয় খাতেই অর্থনীতিবিদেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। বিদেশে হেলথ ইকোনমিস্ট (স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ) ও এডুকেশন ইকোনমিস্টদের (শিক্ষা অর্থনীতিবিদ) এখন অনেক চাহিদা। কারণ, তাঁরা এই খাতগুলো বোঝেন। অর্থনীতির প্রশিক্ষণ তাঁদের একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমস্যা অনুধাবন ও মীমাংসা করতে শেখায়, যা অনেক সময় এসব খাতের অন্য বিশেষজ্ঞরা একইভাবে পারেন না।

পড়ার আছে কত–কী

অর্থনীতি পড়লে সামাজিক অনেক সম্পর্কের বৈজ্ঞানিক, মনোজাগতিক ও আর্থিক দিক সম্পর্কে জানা যায়। বাজার কীভাবে চলে, টাকা কীভাবে তৈরি হবে, বাণিজ্য কীভাবে হবে, নানা কিছু এর সঙ্গে জড়িত। মানুষের আচরণ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কীভাবে পরিবেশদূষণ কমানো যায়—এসবও এখন অর্থনীতি পাঠের অংশ। অর্থনীতি একদিকে যেমন অনেক তত্ত্বকে বিশ্লেষণ করে, তেমনি বাস্তবসম্মত উদাহরণসহ বাস্তব দুনিয়ার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের সুযোগ করে দেয়। অর্থনীতি পড়লে শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণা, উপাত্ত বিশ্লেষণ ও অর্থনৈতিক মডেলিংয়ের মাধ্যমে বাস্তবিক অভিজ্ঞতা অর্জন সহজ হয়। নতুন এই বিশ্বে আগামী দিনগুলোয় আমাদের অর্থনীতিবিদদের প্রধান সমস্যা হবে মানবমন বা হিউম্যান বিহেভিয়র বোঝা। কীভাবে মানুষকে সৎ থাকতে অনুপ্রেরণা দিলে সে দুর্নীতি করবে না? কীভাবে পলিসি ডিজাইন করলে মানুষ রাস্তায় ময়লা না ফেলে ডাস্টবিনে ফেলবে? সামনে আমাদের অনেক কাজ, কারণ আমরা সবাই–ই দেশের মানুষের ভালো চাই, বাংলাদেশের অগ্রগতি দেখতে চাই। সেটা সবদিক থেকে—জিডিপিতে ও মনমানসিকতায়। এই সব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক পরিবর্তন আনার বড় সুযোগ অর্থনীতিবিদদের আছে।