প্রতিনিধি দিনাজপুর
দিনাজপুরে সবার আগে বাজারে আসবে মাদ্রাজি; তারপর বোম্বাই, বেদানা ও চায়না–থ্রি লিচু | ফাইল ছবি |
লিচুগাছের গাঢ় সবুজ পাতার ফাঁকে ঘাপটি মেরে থাকার চেষ্টায় হালকা সবুজ রঙের গুটিগুলো। তবে গুটির গায়ে ঝলমলে রৌদ পড়ায় ঘাপটি মেরে থাকার সে চেষ্টা খানিকটা বৃথা। পাতা ভেদ করে লিচুর গুটিগুলো লিচুপ্রেমীদের জানান দিচ্ছে, সময় মাত্র দুই থেকে তিন সপ্তাহ। এর মধ্যে লাল-গোলাপি সাজে বাজারে আসবে টসটসে লিচু। খোসা ছাড়িয়ে মুখে দিয়েই লিচুপ্রেমীরা পাবেন অমৃত স্বাদ। ট্রাকভর্তি লিচু যাবে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
লিচুর রাজ্য হিসেবে খ্যাতি আছে দিনাজপুরের। জেলার ব্র্যান্ডিংও করা হয়েছে লিচুকে দিয়ে। এখানে চাষ হয় মাদ্রাজি, বেদানা, হাড়িয়া বেদানা, বোম্বাই, চায়না-থ্রি, চায়না–টু, কাঁঠালি ও মোজাফফরি জাতের লিচু। জেলার প্রায় সব জায়গায় কমবেশি লিচুর চাষ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় সদর উপজেলার মাসিমপুর, ঘুঘুডাঙ্গা ও উলিপুর, বিরলের মাধববাটি, করলা, রবিপুর, রাজারামপুর, মহেশপুর, বটহাট ও রানীগঞ্জ, খানসামার গোলাপগঞ্জ ও কাচিনীয়া, বীরগঞ্জের সনকা ও চিরিরবন্দরের কারেন্ট হাট এলাকায়। চাষের জন্য উপযোগী বেলে-দোঁআশ মাটি হওয়ায় এসব এলাকায় লিচু চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, জেলায় ৫ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে লিচুবাগান আছে ৯ হাজার ৯৮টি। এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪ হাজার ৬২৮ টন।
দিনাজপুরের মাসিমপুর ও উলিপুর, বিরলের মাধববাটি ও রবিপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকার লিচুবাগান ঘুরে দেখা যায়, শেষ সময়ের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। লম্বা পাইপ দিয়ে গাছের আগা পর্যন্ত কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে। গত ১২ দিনে এই জেলায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ায় এবার লিচুর গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সেচের প্রয়োজন পড়ছে না। চাষিরা বলছেন, এখন পর্যন্ত অনুকূল আবহাওয়া থাকায় চাষি ও বাগানমালিকেরা কিছুটা ভারমুক্ত আছেন।
সদর উপজেলার কসবা এলাকায় লিচুচাষি শাহজাহান আলী (৪৪) বাগানে পোকামাকড় দমনে কীটনাশক ছিটাচ্ছিলেন। আলাপচারিতায় বলেন, ৫০টি বেদানা লিচুর বাগান তাঁর। গত তিন বছর বাগান চুক্তি দিয়েছিলেন, এবার নিজে করছেন। গত মৌসুমে মাত্র কয়েকটি গাছে ফলন আসে। তবে এবার প্রায় সব গাছে ফলন এসেছে। গুটির আকারও বেশ বড় হয়েছে। ধারণা করছেন, এবার প্রতিটি গাছে গড়ে সাড়ে তিন হাজার লিচু পাবেন। সবকিছু ঠিক থাকলে লিচুতে এবার লাভ হবে।
বিরল উপজেলার পুরিয়া এলাকার লিচুচাষি আফজাল হোসেন বলেন, গত বছর মাদ্রাজি লিচুর দাম পেয়েছেন হাজারে ২ হাজার ২০০ টাকা। এবার হয়তো বাজারটা একটু ভালো যাবে।
গাছে গাছে গাঢ় সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে হালকা সবুজ লিচুর গুটি। দিনাজপুর সদর উপজেলার উলিপুর এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
লিচু ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মামুন বলেন, দিনাজপুরে মে মাসের ১০ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে লিচুর ভরা মৌসুম শুরু হবে। সবার আগে বাজারে আসবে মাদ্রাজি; তারপর বোম্বাই, বেদানা ও চায়না–থ্রি। সবশেষে বাজারে আসবে হাড়িয়া বেদানা, কাঁঠালি ও মোজাফফরি জাতের লিচু। তিনি বলেন, লিচুর বাজার ব্যবস্থাপনাটা সুন্দর করা জরুরি। শহরের কালিতলা এলাকায় বাজারটি বসলে প্রথমত যানজটে ভোগান্তি পোহাতে হয়, অন্যদিকে চাষিরাও সঠিকভাবে লিচু বিক্রি করতে পারেন না। ট্রাক প্রবেশ ও বের হওয়া নিয়ে ঝামেলা তৈরি হয়। বাজারটি গোর-এ-শহীদ মাঠে স্থানান্তর করলে সব দিক থেকেই ভালো হয়।
জেলায় সবচেয়ে বেশি লিচুর বাগান বিরল উপজেলায়। লিচুর উৎপাদন ও পরিচর্যা নিয়ে এই উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মোস্তফা হাসান ইমাম বলেন, এবার লিচুর ফলন খুবই ভালো। তুলনামূলকভাবে তাপমাত্রা কম থাকায় রোদে পুড়ে যাওয়া, পোকার আক্রমণ ও ঝরে পড়ার হার কম। বর্তমানে লিচুর আকার দেড় থেকে দুই সেন্টিমিটার হয়েছে। এখন শাঁস বৃদ্ধির সময় চলছে। এ সময় মাটিতে পর্যাপ্ত রসের দরকার হয়। সম্প্রতি বৃষ্টি হওয়ায় বাড়তি সেচও দিতে হচ্ছে না চাষিদের। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এবার লিচুর আকার বড় হবে, মিষ্টি হবে। কিছু কিছু গাছে ফলন কম, এটা ঠিক। কারণ, প্রতিবার একই রকম ফলন হয় না, এটা লিচুর একটা বৈশিষ্ট্য। তবে সবচেয়ে ভালো বিষয় হচ্ছে, তুলনামূলকভাব কৃষকদের মধ্যে লিচুর যত্ন ও পরিচর্যা বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে। এ কারণ, গত দুই বছরে এই উপজেলা থেকে ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস ও ইংল্যান্ডে লিচু রপ্তানি করা হয়েছে।