[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

জয়দেবপুরে দুর্ঘটনা: চলাচল স্বাভাবিক করতে লাগল ৩১ ঘণ্টা, রেলের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন

প্রকাশঃ
অ+ অ-

গাজীপুরে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনার পর উদ্ধার অভিযান। শনিবার দুপুরে গাজীপুর মহানগরীর জয়দেবপুর জংশনের দক্ষিণে আউটার সিগনালে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

গাজীপুর প্রতিনিধি: রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে ছাড়ার কথা ছিল গতকাল শনিবার সকাল ৯টা ১০ মিনিটে। সেই ট্রেনে বগুড়ার সান্তাহারে যাওয়ার কথা খায়রুল আলমের। তিনি স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে সকাল আটটার মধ্যেই কমলাপুর পৌঁছান।

বেলা একটার দিকে কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, শত শত যাত্রী অপেক্ষমাণ। তীব্র গরমের মধ্যে কেউ দাঁড়িয়ে আছেন, কেউ বসে আছেন, কেউ ক্লান্ত হয়ে স্টেশনের বসার জায়গায় শুয়ে পড়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছিল খায়রুল আলমের পরিবারও।

খায়রুল আলম বলেন, ‘ট্রেনটি কোথায় আছে, আসতে কতক্ষণ লাগবে, কিছুই জানতে পারছি না। একবার এলইডি বোর্ডে (ট্রেন ছাড়ার সময়সূচি দেখানোর পর্দা) দেখাল ট্রেন ১২টা ৪০ মিনিটে ছাড়বে। আবার এখন দেখাচ্ছে ১টা ২০ মিনিটে ছাড়বে।’

খায়রুল আলমের স্ত্রী মেঘনা আলম বলেন, এই গরমে খুব কষ্ট হচ্ছে, খারাপ লাগছে। মেয়েটা বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত কমলাপুর স্টেশনে দেখা যায়, শত শত মানুষের মতো খায়রুল আলমের পরিবারও ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষায় ছিল।

শুধু রংপুর এক্সপ্রেস নয়, ঢাকামুখী ও ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া সব ট্রেনই গতকাল ২ থেকে ৭ ঘণ্টা দেরি করেছে। এই সূচি বিপর্যয়ের কারণ গাজীপুরের জয়দেবপুরে আগের দিন শুক্রবার তেলবাহী ট্রেনের সঙ্গে টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের সংঘর্ষ। রেলকর্মীদের ‘সংকেতজনিত ভুলে’ ওই দুর্ঘটনা ঘটে শুক্রবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে। এতে নয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়। আহত হন চারজন। শুক্রবার বিকেলে উদ্ধারকারী ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌঁছার পর উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয়। গতকাল বেলা ১১টার দিকে দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেন দুটি লাইন থেকে সরানো হয়। এরপর ওই লাইন মেরামত করে ট্রেন চলাচল শুরু করা হয় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে।

সব মিলিয়ে একটি দুর্ঘটনার পর ট্রেন লাইন সচল করতে লেগেছে ৩১ ঘণ্টার বেশি। ওদিকে স্টেশনে স্টেশনে টিকিট কাটা যাত্রীরা ভিড় করেছিলেন। কারও কারও ট্রেন সময়মতো আসেনি। কারও কারও ট্রেন এলেও স্টেশনে বসে ছিল। কারও কারও ট্রেন ছেড়ে গিয়ে যাত্রাপথে থেমে ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

রেলের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার বলেন, ঢাকামুখী এবং ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া কোনো ট্রেনই সময়মতো চালানো যায়নি। যাত্রীদের মধ্যে যাঁরা টিকিট ফেরত দিতে চেয়েছেন, তাঁদের টাকা পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, শুধু রাজশাহী স্টেশনে সকালেই ৩৬০টি টিকিট ফেরত নেওয়া হয়েছে।

রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, জয়দেবপুরে দুর্ঘটনাস্থলে লাইন মেরামত করা হলেও সূচি স্বাভাবিক হতে আজ রোববার পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। যাত্রীদের প্রশ্ন, একটি দুর্ঘটনার পর দুটি ট্রেন লাইন থেকে সরাতে ও লাইনটি মেরামত করতে এত সময় লাগবে কেন। আর সময় যদি লাগবেই, সেটা যাত্রীদের জানিয়ে দেওয়া যেত। তাহলে সকালেই তাঁরা স্টেশনে আসতেন না। স্টেশনে এনে দিনভর বসিয়ে রেখে ভোগান্তি দেওয়া দায়িত্বহীনতা।

মেরামতে দেরি কেন
জয়দেবপুরে দুর্ঘটনার পর দুটি ট্রেন উদ্ধার ও রেললাইন মেরামতে ৩১ ঘণ্টার বেশি সময় লাগার কারণ জানতে চাইলে রেলের কর্মকর্তারা বলেছেন, ওই দুর্ঘটনায় ট্রেন দুটির ইঞ্জিন আটকে গিয়েছিল। এ কারণে দেরি হয়েছে। তাঁরা আরও বলছেন, শুধু দুর্ঘটনা নয়, সূচি বিপর্যয়ের আরও কারণ আছে। যমুনা নদীর ওপর নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেলসেতুতে নতুন রেল সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর (সড়ক ও রেল চলাচল করে) দুই পাশে যে চারটি রেললাইন রয়েছে, তার দুটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ট্রেন পারাপার কমাতে হয়েছে। এর বাইরে আরেকটি কারণ হলো, ঢাকা থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত রেলের তৃতীয় ও চতুর্থ লাইনের কাজ চলমান। এ জন্য টঙ্গীর পরে স্বয়ংক্রিয় সংকেতব্যবস্থা কার্যকর নেই।

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, গাজীপুরের দুর্ঘটনাটি বেশ জটিল ছিল। এ জন্য উদ্ধারে কিছু বেশি সময় লেগেছে। সময়সূচি বিপর্যয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, দুর্ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি রেললাইনে কিছু উন্নয়নমূলক কাজ চলছে। ফলে কিছু কিছু জায়গায় ট্রেন চলাচল সংকুচিত করতে হয়েছে। রোববারের মধ্যে সময়সূচি ঠিক হয়ে যাবে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, একটি লাইন দিয়ে ট্রেন চলার কারণে জয়দেবপুর ও ধীরাশ্রম স্টেশনে আসা-যাওয়ার ট্রেনগুলোতে অপেক্ষায় রেখে একটি একটি করে চলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে দুর্ঘটনাস্থল পার করতে প্রতিটি ট্রেনের এক থেকে দেড় ঘণ্টা বেশি সময় লেগেছে।

বেশি গরমের কারণে রেললাইন বেঁকে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এই আশঙ্কায় গত ১৬ এপ্রিল থেকে ট্রেনের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ কারণেও ট্রেনের স্বাভাবিক চলাচলে কিছুটা বিঘ্ন ঘটছে।

একটি দুর্ঘটনার পর ট্রেন উদ্ধার ও লাইন চালু করতে ৩১ ঘণ্টার বেশি সময় লাগা যৌক্তিক কি না, জানতে চাইলে গণপরিবহনবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান বলেন, রেল দুর্ঘটনার উদ্ধারকাজ চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু ৩১ ঘণ্টা অনেক বেশি সময়। এর অর্থ হচ্ছে উদ্ধারের যন্ত্রপাতি ও লোকবলের সক্ষমতার ঘাটতি আছে। তিনি বলেন, রেলে যে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে, এর বেশির ভাগই অবকাঠামো উন্নয়নে। কিছু ক্ষেত্রে বিলাসী প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে। কিন্তু যান্ত্রিক ও জনবলের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়নি। এর খেসারত ভোগান্তির মাধ্যমে দিচ্ছেন যাত্রীরা।

সারা দেশে প্রভাব
বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে দিনে ৩০টির মতো ট্রেন চলাচল করে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের পথে চলে আরও ৩০টির মতো ট্রেন। এর সব কটিই গতকাল দেরি করেছে। রংপুর এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, রাজশাহী রুটের সিল্ক সিটি ও বনলতা, জামালপুর রুটের অগ্নিবীণা ও ময়মনসিংহ রুটের বলাকা ট্রেন সবচেয়ে বেশি দেরিতে ছেড়েছে।

ঢাকা-রাজশাহী পথে চলাচলকারী সিল্ক সিটি ট্রেন বেলা ২টা ৪০ মিনিটে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। রাত ৮টা পর্যন্ত ট্রেনটি রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসেনি। রেলওয়ে সূত্র জানায়, দেরির কারণে কর্মকর্তারা এই ট্রেনের যাত্রা বাতিল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আগামীকাল ট্রেনটির সাপ্তাহিক বন্ধ থাকায় ৭-৮ ঘণ্টা দেরিতে হলেও চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ঢাকা থেকে উত্তরের পথে চলাচলকারী বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনও গত রাত আটটা পর্যন্ত কমলাপুরে পৌঁছায়নি। অথচ বেলা দেড়টায় এই ট্রেনের চাঁপাইনবাবগঞ্জের পথে ঢাকা থেকে ফিরতি যাত্রা করার কথা ছিল।

জয়দেবপুর হয়ে উত্তরের পথে ট্রেন চললেও এর প্রভাব ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট পথেও পড়েছে। রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম পথের চট্টলা এক্সপ্রেস ট্রেন বেলা পৌনে দুইটায় ঢাকা ছাড়ার কথা ছিল। কিন্তু বিকেল সাড়ে চারটার দিকেও ট্রেনটি স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল। ঢাকা-সিলেট পথের কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনও এক ঘণ্টা দেরিতে ঢাকা ছাড়ে। খুলনাগামী চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেন সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা দেরিতে চলাচল করেছে।

‘কেউ কিছু বলছে না’
কমলাপুর স্টেশনে গতকাল বেলা একটার দিকে গিয়ে দেখা যায়, যাত্রীদের বসার জন্য নির্ধারিত জায়গাগুলো পরিপূর্ণ। বসার জায়গা না পেয়ে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে ছিলেন। কেউ কেউ কাগজ বিছিয়ে মেঝেতে বসে ছিলেন। শিশুসন্তান ও প্রবীণদের হাতপাখা, পুরু কাগজ দিয়ে বাতাস করছিলেন স্বজনেরা।

যাত্রীরা অভিযোগ করছিলেন, ট্রেন কখন আসবে, কখন ছাড়বে, তা কেউ কিছু বলতে পারছিলেন না। ফলে বাসায় ফিরে যাওয়ার সুযোগও ছিল না। চট্টলা এক্সপ্রেসের টিকিট কাটা যাত্রী সালাম সরকার বলেন, টিকিট বাতিল করে বাসে যেতে তিনি কমলাপুল স্টেশনের তথ্য সহায়তা কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্তরা কেউ কিছু বলতে পারেননি।

কোনো কোনো ট্রেন স্টেশনে ছিল। তাতে যাত্রী উঠে বসেও ছিলেন। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার লক্ষণ ছিল না। নেত্রকোনাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের কোচে বসে ট্রেন ছাড়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন আবদুল মজিদ। বেলা দুইটার দিকে তিনি বলেন, ‘ট্রেনে উঠে বসে আছি। ছাড়ার কোনো নাম নেই। কখন ছাড়বে, আরও কত দেরি হবে, কেউ কিছু বলছে না।’

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন