[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

সড়কে চলতে গিয়ে পুড়ে মারা গেলেন তাঁরা

প্রকাশঃ
অ+ অ-
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে তেলবাহী লরি উল্টে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ সময় পাশের আরও চারটি গাড়ি আগুনে পুড়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডে মারা যান তিনজন। মঙ্গলবার সকালে ঢাকার অদূরে সাভারের জোরপুল এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন  

নিজস্ব প্রতিবেদক: আর পাঁচজন মানুষের মতো তাঁরাও সড়কে নেমেছিলেন। কারও গন্তব্য ছিল বাজার, উদ্দেশ্য ছিল পণ্য বিক্রি। কারও গন্তব্য ছিল নিজের বাড়ি, উদ্দেশ্য ছিল স্বজনের কাছে যাওয়া। তবে গন্তব্যে যাওয়া হলো না, পথেই আগুনে পুড়লেন তাঁরা। মারা গেলেন তিনজন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালে সাতজন।

ঢাকার অদূরে সাভারের জোরপুল এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মঙ্গলবার ভোরে এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, একটি জ্বালানি তেলবাহী যান (লরি) উল্টে তেল ছড়িয়ে পড়ে। এতে আশপাশে থাকা দুটি ট্রাক, একটি কাভার্ড ভ্যান ও একটি গাড়িতে (প্রাইভেট কার) আগুন লেগে যায়। ওই সব যানবাহনে থাকা যাত্রী ও পরিবহনশ্রমিকদের ১০ জন পুড়ে যান।

পুড়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়। তাঁদের মধ্যে একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে মারা যান। চিকিৎসকেরা আগেই জানিয়েছিলেন, ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা ব্যক্তিদের মধ্যে এক শিশুসহ চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। দুর্ঘটনার পর আটজনকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।

জ্বালানি তেলবাহী যানটি উল্টে যাওয়ার পেছনে রয়েছে ‘গাফিলতি’। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের যেখানে এ ঘটনা ঘটেছে, সেখানে ‘ইউটার্ন’ (যানবাহন ঘোরার জায়গা) বানাতে রাস্তার ওপর সিমেন্ট ও বালুর তৈরি ব্লক রাখা ছিল। তবে কোনো সতর্কতামূলক নির্দেশনা ছিল না।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলাচলকারী ট্রাকচালক আবদুল আলীম বলেন, ইউটার্ন বানানোর স্থানে সড়কের জায়গা কমে গেছে। রাস্তার ওপর ব্লক দিয়ে কাজ করা হলেও কোনো নির্দেশনা নেই, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা (লাইটিং) নেই। দূর থেকে ব্লক না দেখা গেলে বিপদে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়, দুর্ঘটনা ঘটে।

জ্বালানি তেলবাহী লরিটি মঙ্গলবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে সাভারের জোরপুল এলাকায় পৌঁছায়। সেখানেই চাকার নিচে ব্লক পড়ে সেটি উল্টে যায় বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।

মহাসড়কটিতে ইউটার্ন নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপদ (সওজ) অধিদপ্তর। সংস্থাটির ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রকৌশলী সবুজ খান বলেন, জোরপুলের ইউটার্ন নির্মাণের কাজটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। সেখানে সতর্কতামূলক চিহ্ন দেওয়া এবং আলোর ব্যবস্থা এখনো করা হয়নি। তিনি দাবি করেন, তেলবাহী লরির চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন। তবে সবার জন্য সড়ক নিরাপদ রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

সবুজ খান তেলবাহী লরির চালকের নিয়ন্ত্রণ হারানোর কথা বললেও পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ সে কথা বলেননি। সকাল ১০টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া লরিটি ঘটনাস্থলেই পড়ে আছে। কাছেই কয়েকটি ব্লক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফায়ার সার্ভিসের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ব্লক চাকার নিচে পড়েই লরিটি উল্টে গেছে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করা মো. ইকবালের ভাষ্য, তিনটি যান পাশাপাশি যাচ্ছিল। তেলের লরি ছিল ডান দিকে। মাঝখানে প্রাইভেট কার এবং বাঁ পাশে ছিল তরমুজবাহী ট্রাক। তেলের লরিটির চাকার নিচে ব্লক পড়ে উল্টে গেলে অন্য যান আটকে যায়। তেলের গাড়িতে জ্বলে ওঠা আগুন অন্য যানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

ফায়ার সার্ভিসের আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রায় এক ঘণ্টা লেগেছে। সাভার ফায়ার স্টেশনের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থলের আশপাশে পানির উৎস না থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।

তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক
দগ্ধদের মধ্যে ছয়জনই ছিলেন একটি তরমুজবাহী ট্রাকে। ট্রাকটি বরগুনা থেকে গাজীপুরে যাচ্ছিল। তাঁদের মধ্যে নজরুল ইসলাম (৪৫) নামের এক ব্যক্তি ও ট্রাকচালক মো. হেলাল হাওলাদার (৩০) মারা গেছেন। নজরুল গাজীপুরে মৌসুমি ফলের ব্যবসা করতেন।

ট্রাকচালক হেলাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে মারা যান। বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন মো. তরিকুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, হেলালের শরীরের শতভাগ দগ্ধ হয়েছিল।

হেলাল বরগুনা সদর উপজেলার ছোটগরিচন্না গ্রামের জয়নুউদ্দিন হাওলাদারের ছেলে। তাঁর মামাতো বোন সুইটি জানান, তাঁর স্ত্রীর নাম সনিয়া আক্তার। তিন বছর আগে বিয়ে হয় তাঁদের।

ট্রাকে থাকা দগ্ধ অন্য পাঁচজনের মধ্যে ট্রাকচালক হেলালের সহকারী সাকিবের (২৪) শরীরের প্রায় পুরোটা পুড়ে গেছে। ট্রাকে থাকা নিরঞ্জন রায়ের (৪৫) শরীরের ৮ শতাংশ, বরগুনার কৃষক ও মৌসুমি তরমুজ ব্যবসায়ী আল-আমিনের (৩৫) ১০ শতাংশ এবং তাঁর ১০ বছর বয়সী মেয়ে মিমের ২০ শতাংশ পুড়ে গেছে।

আল-আমিনের বাবা শহিদ তালুকদার খবর পেয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে যান। সেখানে তিনি জানান, মিম বরগুনা সদরের একটি বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার বাবা ট্রাকে তরমুজ নিয়ে গাজীপুর যাবেন, এ কথা শুনেই সে মামাবাড়ি যাওয়ার বায়না ধরেছিল। তার মামাবাড়ি ঢাকার সাভারে। রাস্তায় বাবা-মেয়ে পুড়ে গেল।

এ ঘটনায় সিমেন্টবাহী একটি ট্রাকে আগুন লাগে। সেটির চালকের সহকারী ইকবাল হোসেন ঘটনাস্থলেই মারা যান। ইকবালের স্ত্রী মঞ্জুরা বেগমকে পাওয়া যায় সাভার হাইওয়ে থানায়। তিনি দুই মেয়েসহ সাভারের হেমায়েতপুরে থাকেন। স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে তিনি থানায় যান। মঞ্জুরা বলেন, ‘ফজরের নামাজের পর ট্রাকে সিমেন্ট নিয়ে সে (ইকবাল) বের হইছিল। পরে খবর পাই, ট্রাকে আগুন লাইগা মইরা গেছে।’

সিমেন্টবাহী ট্রাকের চালক আলামিনের (২২) শরীরের ১৫ শতাংশ এবং ট্রাকে থাকা মিলন মোল্লার (২২) শরীরের ৪৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। একটি প্রাইভেট কারের চালক আবদুস সালামের (৩৫) শরীরের ৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, শিশু মিমসহ দুজনের শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তেলবাহী লরিটি কার, কেউ জানে না
তেলবাহী লরিটির মালিকানা কোন প্রতিষ্ঠানের, সেটি জানতে পারেনি পুলিশ। সাভার হাইওয়ে থানার সাময়িক দায়িত্বে থাকা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বাবুল আক্তার বলেন, লরিটি পুড়ে গেছে। কেউ যোগাযোগও করেনি। ফলে লরির মালিক কারা, তা জানা যায়নি। তবে এ ঘটনায় থানায় একটি নিয়মিত মামলা হয়েছে।

দেশে জ্বালানি তেল সরবরাহ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তিন কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। তাদের কাছ থেকে তেল কিনে নেন নিবন্ধিত পরিবেশক ও প্রতিনিধিরা (এজেন্ট)। পরিবেশকেরা নিজস্ব পরিবহনে তেল নিয়ে ফিলিং স্টেশনের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করেন। আর এজেন্টদের ফিলিং স্টেশন নেই। তারা গাড়িতে তেল নিয়ে বিভিন্ন কারখানা বা বড় প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেন।

বিপিসির একটি সূত্রের দাবি, লরিটিতে মেঘনা কোম্পানির তেল ছিল। তবে মেঘনার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. টিপু সুলতান বলেন, ওই লরিতে তাঁদের তেল ছিল না। মেঘনার প্রতিনিধি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

পেট্রলপাম্প মালিক সমিতির একাংশের সভাপতি মিজানুর রহমানও দাবি করেন, গাড়িতে কোনো ফিলিং স্টেশনের তেল ছিল না। সব মিলিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে লরিটির মালিকানা কার।

‘দায় নিতে হবে’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ২০২৩ সালে দেশে সড়কে ৫ হাজার ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। দিনে গড়ে মারা গেছেন প্রায় ১৪ জন।

সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বেপরোয়া গতি, যানবাহনের ফিটনেস না থাকা, রাস্তার ত্রুটির মতো বিষয়গুলো সামনে আসে। এবার দেখা গেল, ‘নির্মাণ উপকরণ ফেলে রাখা ও কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না থাকায়’ দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং মানুষ পুড়ে মরেছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, মহাসড়ক মানে হলো দ্রুতগতি। এ ধরনের কোনো অবকাঠামোতে কোনো পরিবর্তন করা হলে আগাম সতর্কতা দিতে হয়। পতাকা ওড়ানো, ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালানো এবং পড়ে বোঝার জন্য সতর্কবার্তা দিয়ে সেটি করা যেতে পারে। তিনি বলেন, এসব করা না হলে যেকোনো দুর্ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দায় নিতে হবে।

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন