[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

কত প্রাণ হলো বলিদান

প্রকাশঃ
অ+ অ-

সত্তরের নির্বাচনের আগে সৈয়দপুরে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে শহীদ ডা. জিকরুল হক। তার পেছনে দাঁড়ানো তাজউদ্দীন আহমদ | ছবি: সংগৃহীত

মাজেদুল হক তানভীর: ‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জলন্ত/ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে/ নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক/ এই বাংলায়/ তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা’।

বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন সময়ে লেখা কবি শামসুর রাহমানের কবিতাটি একাত্তর সালের এই দিনে সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছিল বাঙালি জাতির জীবনে। আজ থেকে ৫২ বছর আগে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরে এসেছিল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। যে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের ৭ মার্চ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই রেসকোর্স ময়দানেই পরাজয় মেনে মাথা নত করে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিল। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।

অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালি জাতির মহান স্বাধীনতা। জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সেই সব বীর শহীদের। স্বাধীনতার ওই লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার পেছনে রয়েছে সন্তান হারানো লাখো মায়ের আর্তনাদ, পিতা হারানো সন্তানের চিৎকার, সম্ভ্রম হারানো নারীর আহাজারি, অগণিত মানুষের স্বজন হারানোর বেদনা। যাদের ঋণ স্বাধীন বাংলাদেশ কোনো দিন শোধ করতে পারবে না।

বিজয়ের ৫২ বছর পেরিয়ে এসেছে জাতি। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পেরিয়েও আজও অনেকের ত্যাগ ও বীরত্বগাথা অজানাই রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে এমনই একজন ত্যাগী বীর ছিলেন শহীদ ডা. জিকরুল হক।

জিকরুল হক ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এমপিএ (মেম্বার অব প্রভিনশিয়াল অ্যাসেম্বলি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার নির্বাচনী এলাকা ছিল অবাঙালি-অধ্যুষিত। তা সত্ত্বেও তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। মূলত জনসেবা, শিক্ষা বিস্তার ইত্যাদি কাজে জড়িত থাকার কারণে। তিনি একজন চিকিৎসক, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে খ্যাতিমান ছিলেন।

জিকরুল হকের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. মোনায়মুল হক দৈনিক বাংলাকে জানান, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাবাকে ‘বড়ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। একাত্তরের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বিকেল ৩/৪টার দিকে ফোনে কথা হয় তার বাবার। বঙ্গবন্ধু সৈয়দপুর শহরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার কাছ থেকে জানার পর আত্মগোপনে যেতে বলেছিলেন। বাবা তা করেননি।”

২৫ মার্চ রাতেই সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল জিকরুল হককে তার নতুন বাবুপাড়ার বাড়ি থেকে ধরে সেনানিবাসে নিয়ে যায়। এরপর ১২ এপ্রিল রংপুর ক্যান্টনমেন্টের নিসবেতগঞ্জে এক বধ্যভূমিতে জিকরুল হকসহ মোট ১৫০ বাঙালিকে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক সহচরও ছিলেন।

মোনায়মুল হক আরও জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় জিকরুল হকের আপন দুই ভাই জহুরুল হক ও আমিনুল হক এবং ভাইপো কুদরত-ই-এলাহীসহ আট আত্মীয় শহীদ হন। তার দুই ভাইয়ের একজনকে জুন মাসের মাঝামাঝি এবং আরেকজনকে ১৪ ডিসেম্বর অবাঙালিরা হত্যা করে। ১৯৯৬ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ডাক বিভাগে তার নামে স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করা হয়। ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেন।

পাকিস্তানি শাসনামলে এক অবাঙালি ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তায় স্থানীয় অবাঙালিরা সৈয়দপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে খেলার মাঠে উর্দু স্কুল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অবাঙালি অধ্যুষিত একই এলাকায় পাশাপাশি দুটি স্কুল নির্মাণ হলে সহিংসতার শঙ্কা ছিল। জিকরুল হক স্থানীয় নেতা ও বাঙালিদের সহযোগিতায় উর্দু স্কুল নির্মাণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

জিকরুল হকের জন্ম ১৯১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর, সৈয়দপুরে। তার আদি পৈতৃক নিবাস দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার পলাশবাড়ীতে। বাবা শেখ জিয়ারতউল্লাহ আহমদ, মা খমিউননেছা চৌধুরানী। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। জিকরুল হক নয় ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।

১৯৩৩ সালে সৈয়দপুর বাংলা উচ্চবিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৩৯ সালে কলকাতার ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুল থেকে এলএমএফ পাস করেন। মেডিকেল স্কুলে পড়ার সময় সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

কলকাতা ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাহচর্যে আসেন এবং ভারত ভাগের পর তাদের অনুপ্রেরণায় রাজনীতিতে অংশ নেন। তিনি ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরপর তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। জিকরুল হক থানা মুসলিম লীগের সেক্রেটারি ও পরে সভাপতি এবং পরবর্তীতে জেলা আওয়ামী লীগের আমরণ সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন।

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন