[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

‘ইন্ডিয়া’ জোটের কারণে কি এবার মোদি দেশের নাম বদলে দিচ্ছেন

প্রকাশঃ
অ+ অ-

প্রতিনিধি নয়াদিল্লি: ক্ষমতাসীন বিজেপিবিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র মোকাবিলায় নরেন্দ্র মোদির সরকার কি তবে দেশের ইংরেজি নামটাই বাদ দিতে চলেছেন? ভারতীয় রাজনীতিতে এই আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর পাঠানো চিঠির বদৌলতে। জি–২০ শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মুর্মু বিদেশি অতিথিদের সম্মানে ৯ সেপ্টেম্বর নৈশভোজের আয়োজন করেছেন। ‘ভারত মন্ডপম’–এ সেই আয়োজনে যোগ দিতে রাষ্ট্রপতি যে চিঠি দিয়েছেন, তাতে ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’র বদলে লেখা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’। চিরায়ত এই প্রথা থেকে আচমকা সরে আসার ফলে প্রশ্ন উঠেছে—তবে কি সংসদের বিশেষ অধিবেশনে বিরোধী জোটের মোকাবিলায় মোদি সরকার দেশের ‘ইন্ডিয়া’ নামটাই জলাঞ্জলি দিতে চলেছে?

সরকারিভাবে এখনো কেউ এর কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। সে জন্য জল্পনার অবসানও ঘটেনি; বরং রাজনৈতিক মহল ও সামাজিক মাধ্যমে মতামতের বন্যা বইছে। প্রবল জল্পনা, ১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সংসদের যে বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে, সেখানেই সম্ভবত সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ–সংক্রান্ত বিল পেশ করা হবে। ওই বিশেষ অধিবেশন কী কারণে, কী আলোচিত হবে—তা সরকারিভাবে এখনো সংসদ সদস্যদের জানানো হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, জি–২০ শীর্ষ সম্মেলন শেষ হলে তা জানানো হবে।

রাষ্ট্রপতি ভবনের ইংরেজি আমন্ত্রণপত্রে এতকাল ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’ লেখা হতো। এবারই প্রথম ইন্ডিয়ার বদলে ইংরেজিতে লেখা হলো ‘ভারত’। সেই আমন্ত্রণপত্রের প্রতিলিপিজুড়ে কংগ্রেস মুখপাত্র জয়রাম রমেশ মঙ্গলবার ‘এক্স’ হ্যান্ডেল (সাবেক টুইটার) মারফত বললেন, ‘তা হলে যা শুনছিলাম, তা সত্যি। রাষ্ট্রপতি ভবন ৯ সেপ্টেম্বর নৈশভোজের যে আমন্ত্রণ জি–২০ নেতাদের পাঠিয়েছে, তাতে ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’–এর বদলে লেখা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’। এরপর থেকে সংবিধানের ১ নম্বর অনুচ্ছেদ হয়তো এভাবে লেখা হবে, ‘ভারত, যা ছিল ইন্ডিয়া, রাজ্যসমূহের সমষ্টি।’ কিন্তু তা হলেও রাজ্যের সমষ্টির ওপর হামলা কমবে না।’

ভারতের সংবিধানের ১ নম্বর অনুচ্ছেদে লেখা আছে, ‘ইন্ডিয়া, দ্যাট ইজ ভারত…।’ অর্থাৎ, যা ইন্ডিয়া তা–ই ভারত। মোদি সরকার ‘ইন্ডিয়া’ তুলে দিতে চাইলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।

এই জল্পনা দানা বেঁধেছে যেদিন থেকে বিরোধীরা বিজেপির বিরুদ্ধাচরণে জোটের নাম রেখেছে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স’, ইংরেজি আদ্যক্ষর নিয়ে সংক্ষেপে যা ‘ইন্ডিয়া’। এই নামকরণ শুরু থেকেই বিজেপির অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি সারা দেশে পরিচিত। বিরোধীরাও নিজেদের ‘ইন্ডিয়া’র প্রতিনিধি বলে জাহির করতে শুরু করেন। বিব্রত বিজেপি কটাক্ষ করলেও বুঝতে পারছিল, বিরোধীরা ক্রমে লড়াইটা ‘ইন্ডিয়া’ বনাম বিজেপি জোট ‘এনডিএ’–তে পরিণত করতে চাইছে। সেটি তাদের অস্বস্তি বাড়াতে থাকে।

প্রথমে বিজেপি নেতারা ‘ইন্ডিয়া’ উচ্চারণ না করে ‘আইএনডিআইএ’ বলতে থাকেন। কিন্তু তাতে লাভ হয় না। এরপর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে কটাক্ষ করে বলেন, ব্রিটিশরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৈরি করে দেশে ঢুকে শাসক হয়েছিল। সন্ত্রাসবাদীদের সংগঠনেও ইন্ডিয়া আছে।’ পাশাপাশি তিনি মহাত্মা গান্ধীর ‘কুইট ইন্ডিয়া’ বা ভারত ছোড়ো আন্দোলনের উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদেরও মন্ত্র হলো, বিরোধীদের দুর্নীতি কুইট ইন্ডিয়া, পরিবারতন্ত্র কুইট ইন্ডিয়া’, তোষণনীতি কুইট ইন্ডিয়া।’ তিনি বলেছিলেন, এই ইন্ডিয়াকে ভারতছাড়া করলেই দেশ মুক্তি পাবে।

কিন্তু তাতেও বিজেপির অস্বস্তি দূর হয়নি; বরং মুম্বাইয়ে ইন্ডিয়া জোটের তৃতীয় সম্মেলনের সময় থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে জোটের ক্যাচলাইন ব্যবহৃত হতে থাকে, ‘জুড়েগা ভারত, জিতেগা ইন্ডিয়া’।
   
‘ইন্ডিয়া’র বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে বিজেপি অবশ্য কিছুদিন ধরেই সচেষ্ট। দেশদ্রোহ আইন খারিজসহ ইন্ডিয়ান পেনাল কোড বা ভারতীয় দণ্ডবিধিতে সংস্কার ঘটাতে বেশ কিছু সুপারিশ আনা হয়। সেই সঙ্গে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের নামকরণও করা হয়েছে হিন্দিতে, ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা’। এতে দুটি লক্ষ্য পূরণ হবে বলে বিজেপি মনে করছে। প্রথমত, ইংরেজির বদলে দেশের সর্বত্র হিন্দির প্রসার ও বিস্তার; দ্বিতীয়ত, ‘ইন্ডিয়া’ শব্দ উচ্চারণের বিড়ম্বনা থেকে রেহাই। বিজেপির যুক্তি—এভাবে তারা ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে চাইছে।

কয়েক দিন আগে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবতও এই সুরে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দেশে সব সরকারি কাজে ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটির ব্যবহার বন্ধ হওয়া দরকার। তার বদলে ব্যবহার করা উচিত ‘ভারত’। তাঁকে সমর্থন জানিয়ে বিজেপির রাজ্যসভার সদস্য হরনাথ সিং যাদব বলেছিলেন, ‘ইন্ডিয়া’ নাম বাদ দেওয়ার জন্য সংবিধান সংশোধন করা দরকার। ইন্ডিয়া শব্দটি ব্রিটিশদের আমদানি করা। ওটা এক ধরনের গালি। ‘ভারত’ শব্দের মধ্যে রয়েছে দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিচ্ছুরণ।

ক্ষমতাসীন হয়ে রাজ্যে রাজ্যে ও কেন্দ্রে বিজেপি বহু নাম বদল করেছে। বিশেষ করে মোগল আমলের পরিচয় বহনকারী শহর, নগর, জেলা ও রাস্তার নাম বদলের মধ্য দিয়ে তারা হিন্দুত্বের বিকাশ ঘটাতে চেয়েছে। এলাহাবাদ হয়েছে প্রয়াগরাজ, মোগলসরাই স্টেশনের নামকরণ হয়েছে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামে। রাষ্ট্রপতি ভবনের মোগল উদ্যানের নাম বদলে হয়েছে অমৃত উদ্যান। মুসলমান–ছোঁয়া ছাড়াও যে নাম বদল হয়নি তা নয়। রাজপথের নাম বদলে মোদি কর্তব্যপথ রেখেছেন।

এবার সমূলে ‘ইন্ডিয়া’ উৎপাটিত হতে চলেছে কি? সেই জল্পনা তীব্র হয়েছে। বিজেপি সাংসদ পরভেশ ভার্মা ইতিমধ্যেই এক বেসরকারি বিল প্রস্তুত করেছেন, যাতে সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘ইন্ডিয়া’ বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

বিরোধীরা অবশ্য দমছেন না। জয়রাম রমেশ বলেছেন,‘ ইন্ডিয়া ও ভারতের লক্ষ্য এক। ইংরেজিতে ভারতের অর্থ ‘ব্রিং হারমোনি, অ্যামিটি, রিকনসিলিয়েশন অ্যান্ড ট্রাস্ট।’ অর্থাৎ সম্প্রীতি, বন্ধুত্ব, পুনর্মিলন ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। ইন্ডিয়া তো সেটিই চায়। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানতে চেয়েছেন, ইন্ডিয়া জোট যদি নাম বদলে ‘ভারত’ রাখে, তাহলে বিজেপি কি ভারতের নামও বদলে দেবে?

রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নেতা মনোজ ঝা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এই তো কদিন হলো বিরোধী জোটের নামকরণের। এর মধ্যে এতই গায়ে জ্বালা ধরেছে যে দেশের নাম বদলাতে হচ্ছে? প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘এরা দেখছি দেশেরও নাম বদলাচ্ছে? কোন দিন দেখব, রবি ঠাকুরের নাম বদলে দিয়েছে!’

বিজেপি নেতারাও উঠে পড়ে লেগেছেন। দলের সভাপতি জগৎ প্রকাশ নাড্ডা জানতে চান, কংগ্রেসের এত গাত্রদাহ কেন? ভারত জোড়ো যাত্রীদের কেন ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলতে অনীহা? কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান জাতীয় সংগীতের প্রথম দুই লাইন তুলে দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, ভারত ভাগ্য বিধাতা, জয় হো। আর আসামের মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ‘আমাদের সভ্যতা গৌরবের সঙ্গে অমৃতকালের দিকে এগিয়ে চলেছে।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ঠাট্টা–ইয়ার্কি–কৌতূকেরও অন্ত নেই। কেউ বলছেন, এবার তাহলে ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র নাম বদলে হবে ‘ভারত অব ইন্ডিয়া’, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের নাম হবে ‘ভারতীয় এক্সপ্রেস’। এই অবসরে অমিতাভ বচ্চন ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে শুধু লিখেছেন, ‘ভারত মাতা কি জয়’।

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন