আশ্চর্য নীল রঙের এক পোর্ট্রেট

হুমায়ূন আহমেদ | অলঙ্করণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

ধ্রুব এষ: এই একটা শীতকাল যায়
আশ্চর্য সন্ধ্যা আর একটাও যায় না।

সেটা ২০১১-এর শীতকাল। কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হুমায়ূন আহমেদ চিকিৎসার্থে গেছেন আমেরিকায়। নিউইয়র্কের বিশ্ববিখ্যাত স্লোন ক্যাটারিং হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আশ্চর্য সন্ধ্যা কী করে যায় আর, বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদলের মতো, আমার সন্ধ্যা?

আশ্চর্য কিংবা অনাশ্চর্য যেকোনো সন্ধ্যার সম্ভাবনা সেই শীতকালের আগেই হয়তো নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল।

: স্যার হ্যাজ ডিটেকটেড ক্যানসার! হি ইজ গোয়িং টু ইউএসএ টুনাইট ফর ট্রিটমেন্ট। মাজহার অ্যান্ড ভাবি উইল অ্যাকম্প্যানি। ইফ পসিবল কাম অ্যান্ড প্রে।
মাসুম।

অন্যপ্রকাশের মাসুম রহমানের মেসেজ।

সেন্ট: ১৩.০৯.২০১১   ১১.১১.১১এএম

আমি এর আগে কিছুই জানতাম না। ইফ পসিবল! কাম! আলীম আর আমি সেই সন্ধ্যায় ফেয়ারওয়েল দিতে গিয়েছিলাম স্যারকে? শঙ্কিত হলেও তেমন কিছু ভয় মনে ধরেনি।

চিকিৎসার প্রথম ধাপ হিসেবে স্যার এক দফা কেমো নিয়ে দেশে ফিরলেন। আবার চলে যাবেন অল্প কিছুদিনের মধ্যে। কেমো কাজ না করলে অপারেশন হবে। দেখা করব একবার? আড়ষ্ট লাগে। দোনামনা করি। তবে যাই এক সন্ধ্যায়। সেই আলীম আর আমি। গল্পকার অনুবাদক আলীম আজিজ। বহুকাল ধরে আমরা বন্ধু। হুমায়ূন আহমেদের বিশেষ পছন্দের একজন সে।

পৃথিবীর বিষণ্নতম সেই সন্ধ্যা। বহিরাগত কেউ ছিল না, স্বস্তি। স্যার আমাদের সঙ্গে ফ্লোরমেটে বসলেন। কথা টুকটাক। বলছেন, শুনছি। আলীম কিছু কথা বলল। বিষয়: সাহিত্য। কে একজন চা রেখে গেল তিন কাপ। মুস্তফা, মনজুর না বুলবুল? দেখিনি নাকি? দেখেছি, দেখিনি।

'চা খাও। ধ্রুব, চা খাও।'

'জি।'

কেমো নিলে চুল পড়ে যায়, কাপড়ের হ্যাট পরে আছেন স্যার। হুমায়ূন আহমেদ। সিনেমা যখন ডিরেকশন দেন, এ রকম হ্যাট পরেন আকছার। এত নীল হয়ে আর কখনো পরেননি। কেমো নিয়ে নীল হয়ে গেছেন মানুষটা। আশ্চর্য নীল!

চায়ে দুই চুমুক দিয়ে কাপ রাখলেন, 'এই যে আমি চায়ের কাপ নিলাম, আমার আঙুলে কোনো সাড়া নাই কিন্তু। ধরে আছি কেবল দেখতেছি বলে।'

আমরা কি আরও কিছুক্ষণ বসে থাকব এই মানুষটার সঙ্গে?

চা শেষ। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। রাত এখন। 'ইস রাত কি সুবাহ নেহি' বলে একটা হিন্দি ছবি দেখেছিলাম। কেন মনে পড়ল? 'ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি'র সান্তিয়াগো মনে হলো কেন? কাকে মনে হলো? নীল সান্তিয়াগো। মনে যা হয় বলে-কয়ে হয় না।

বই সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। সংকোচের সঙ্গে দেখালাম।

দেখলেন, 'তোমার লেখা বই?'

'জি।'

বই। দেখছেন বলে ধরলেন। পাতা ওল্টালেন। উৎসর্গ দেখলেন। পড়লেন বা পড়লেন না। বই ফ্লোরে রেখে বললেন, 'পড়ব।'

বইটা আমি তাঁকে উৎসর্গ করেছি।

আলীম বলল, 'স্যার, আমরা আজ উঠি?'

'আচ্ছা, ওঠো।'

আমরা উঠলাম।

'স্যার. আসি।'

'আসো।'

'আবার দেখা হবে।'

'আবার দেখা হবে তুমি শিওর?'

'শিওর।'

'আচ্ছা, যাও।'

সেই শেষ দেখা তাঁর সঙ্গে। আশ্চর্য বিষণ্ন-ক্লান্ত-বেমানান-বিবর্ণ-নীল রঙের এক হুমায়ূন আহমেদ।

আমার পৃথিবীর আর কোনো শীতকালে আর কোনো আশ্চর্য সন্ধ্যা যাবে না। আশ্চর্য নীল সেই সন্ধ্যার স্মৃতি বা নক্ষত্রের রাতে ভিনসেন্ট ভ্যানগগের আঁকা আশ্চর্য নীল রঙের এক পোর্ট্রেট যেনবা, আমি কেবল বিস্মৃত হওয়ার চেষ্টা করেই যাব।

আমার সেই বইয়ের উৎসর্গপত্র:

এই একটা শীতকাল যায়
আশ্চর্য সন্ধ্যা আর একটাও যায় না
হুমায়ূন আহমেদ
শ্রদ্ধাস্পদেষু