[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

আড়ম্বর ও গাম্ভীর্যে রানির শেষকৃত্য

প্রকাশঃ
অ+ অ-
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ | ছবি: এএফিপ

কামাল আহমেদ,লন্ডন থেকে: রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃত্যের চূড়ান্ত পর্বটি আজ সোমবার শুধু যুক্তরাজ্যের জাতীয় শোক প্রকাশের উপলক্ষ নয়, বরং একই সঙ্গে হয়ে উঠছে সাম্প্রতিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সমাবেশ।

যে রাজকীয় অথচ ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ আড়ম্বর ও আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে রানির শেষবিদায় জানানোর আয়োজন করা হয়েছে, তাকে নজরকাড়া বললেও তা কম হবে। জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের বিশালত্ব ও তার সুচারু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যুক্তরাজ্য কার্যত তার বিশেষ পরিচিতির বৈশিষ্ট্য বা ব্রিটিশ ব্র্যান্ডের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করছে।

রানির শেষকৃত্যের আয়োজনটিতে বিভিন্ন দেশের সম্রাট, বাদশাহ, রাজা-রানি, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীদের যেমন মহামিলন ঘটছে, তেমনই একে জাতীয় ঐক্যের স্বাক্ষর হিসেবে প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। গতকাল রাতে আমন্ত্রিত রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা প্রথমবারের মতো একত্র হয়েছেন বাকিংহাম প্রাসাদে রাজা তৃতীয় চার্লসের আমন্ত্রণে এক সংবর্ধনায়। আর আজ মৃত্যুর দ্বাদশ দিনে তাঁরা অংশ নেবেন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে রানির জন্য আয়োজিত রাষ্ট্রীয় প্রার্থনায়।

ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে গির্জায় ধারণক্ষমতা দুই হাজার। তাই পাঁচ শতাধিক বিদেশি অতিথির বাইরে অন্যদের সেখানে প্রবেশাধিকার সীমিত থাকবে। তবে যেখানে রানির মরদেহ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়েছিল সেই ওয়েস্টমিনস্টার হল থেকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে নেওয়া এবং লন্ডন থেকে তাঁর নির্ধারিত সমাধিস্থল উইন্ডসর ক্যাসলে নেওয়ার পথে বিপুল জনসমাগম ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইউরোপ ও আরব দেশগুলোর রাজা-বাদশাহ, জাপানের সম্রাট ও বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টসহ শতাধিক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের জন্য যে ধরনের নিরাপত্তা প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা করতে লন্ডনে যেমন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়েছে, তেমনই সর্বসাধারণের অংশগ্রহণ ও চলাচলের সুযোগও বহাল রাখতে হয়েছে।

এই দুইয়ের সমন্বয় করতে গিয়ে বিদেশি অতিথিদের জন্য পরামর্শ ছিল বাণিজ্যিক যাত্রী বিমানে যাতায়াত করার এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মূল অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য সরকারিভাবে ঠিক করা বাস ব্যবহারের। 

যাঁরা সাধারণ যাত্রী বিমানে না এসে বিশেষ বিমানে ভ্রমণ করেছেন, তাঁদের বিমান হিথরো, গ্যাটউইক কিংবা লুটনেও নামতে দেওয়া হয়নি। শুধু লন্ডনে স্ট্যান্সটেড বিমানবন্দরে সেগুলো অবতরণের ব্যবস্থা রাখা হয়।

বাসে চেপে অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পরামর্শে প্রশ্ন ওঠে, প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে কি বাসে চড়ানো হবে? যুক্তরাজ্য সরকারের তরফে তখন জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে ছাড় দেওয়া হয়েছে, তিনি তাঁর বিস্ট ওয়ান নামে পরিচিত নিজস্ব গাড়িতেই চড়বেন। ছাড় পেয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁও। দ্বিস্তরের এ ব্যবস্থা নিয়ে বিবিসির প্রশ্নের জবাবে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন অবশ্য বলেছেন, বাসে চড়ায় তিনি কোনো সমস্যা দেখেন না।

বাড়তি নিরাপত্তার জন্য লন্ডনের কেন্দ্রে কিছুটা জায়গায় বাসসহ সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হলেও লোকজনের যাতায়াত বন্ধ করা হয়নি। সাত থেকে দশ লাখ মানুষ ছয় থেকে আট ঘণ্টা লাইনে অপেক্ষা করে রানির কফিনে শ্রদ্ধা জানাতে গেছেন।

তাঁদের সবাইকে বিমানবন্দরের মতো নিরাপত্তা তল্লাশির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তাঁদের সবাই যে যুক্তরাজ্যের বাসিন্দা তা–ও নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দূর থেকেও অনেকে এসেছেন। ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রতি বৈশ্বিক কৌতূহল বা আগ্রহের পুরোটাই যাতে আত্মস্থ করা সম্ভব হয়, সে জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোনো ঘাটতি রাখা হয়নি।

রানির পরিণত বয়সে আকস্মিক মৃত্যু হলেও তাঁর এ শেষকৃত্যের অতি দীর্ঘ আচার-আয়োজন হঠাৎ কিছু নয়। এর পেছনে আছে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা। লন্ডন ব্রিজ ইজ ডাউন বা অপারেশন লন্ডন ব্রিজ নামের এ আয়োজন মূলত পুরোটাই সামরিক কার্যক্রম। রানির ৭০ বছরের রাজত্বকালে বহুবার এ পরিকল্পনার হালনাগাদ করা হয়েছে।

পরিকল্পনা তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা ছিল সেনাবাহিনী ও চার্চের, অর্থাৎ রানি খ্রিষ্টধর্মের যে প্রোটেস্ট্যান্ট ধারার প্রধান ছিলেন, সেই ধারার যাজকদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় যাঁরা নেতৃত্ব দেন, তাঁদের। চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ অ্যাডমিরাল স্যার টনি রাডাকিন বিবিসিকে জানান যে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার শেষযাত্রায় তিন বাহিনীর ছয় হাজার সদস্য অংশ নিলেও পুরো কার্যক্রমে নিয়োজিত আছেন মোট দশ হাজার সেনাসদস্য।

এ আয়োজনে সৌদি রাজপরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উপস্থিতির খবরে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত সৌদি আরবের প্রতিনিধিত্ব করছেন প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সল।

চীনা দূতাবাসের একটি প্রতিনিধিদল ওয়েস্টমিনস্টার হলে রানির কফিনে শ্রদ্ধা জানাতে চাইলে হাউস অব কমন্সের স্পিকার লিন্ডসে হয়েল তার অনুমতি দেননি। কয়েকজন এমপির ওপর চীন সরকারের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণেই তিনি পার্লামেন্টের চৌহদ্দিতে তাঁদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন।

ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটায় রুশ প্রেসিডেন্টকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তবে লন্ডনে নিয়োজিত রুশ রাষ্ট্রদূত শেষকৃত্যে অংশ নেবেন বলে কথা আছে।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লিজ ট্রাস দায়িত্ব গ্রহণের পর মন্ত্রিসভা গঠন সম্পন্ন হওয়ার আগেই রানির মৃত্যু হয় এবং এই বিশালাকারের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। রানির মৃত্যুর পর থেকে তাঁর মরদেহ সমাহিত হওয়া পর্যন্ত বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোয় রানির মরণোত্তর আয়োজনগুলো সংবাদ শিরোনাম হয়ে আছে।

টেলিভিশনের পর্দায় এ উপস্থিতি শুধু আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনের বড় বড় আসরের সঙ্গে তুলনীয়। ব্রিটিশ পাউন্ডের মূল্য যে ৩৭ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে গেছে, মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ১০ শতাংশের ঘরে এবং জ্বালানিসংকটের কারণে আসন্ন শীতে জীবনহানির শঙ্কা, এ সবকিছুই চাপা পড়েছে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু ও তাঁর শেষকৃত্যের আড়ম্বরপূর্ণ অথচ গাম্ভীর্যময় আয়োজনের নিপুণ ব্যবস্থাপনায়।

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন