বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে যায়
![]() |
| লক্ষ্মীপুর সদরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। শহরের মাদাম এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
লক্ষ্মীপুরের ইতিহাসে এক গৌরবময় দিন ৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী কৌশলে পালিয়ে যায়। লক্ষ্মীপুর সদরের মানুষ অবরোধমুক্ত হয়, তারা পায় মুক্তির স্বাদ ও বিজয়ের আনন্দ।
পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে এই জেলায় প্রথম প্রতিরোধ গড়ে ওঠে এপ্রিল মাসে। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ (নবম খণ্ড) বইয়ে বলা হয়েছে, শত্রুবাহিনী যেন লক্ষ্মীপুর সদরে ঢুকতে না পারে, সে জন্য স্বাধীনতাকামী জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালীর চৌমুহনী থেকে লক্ষ্মীপুর সদর পর্যন্ত প্রধান সড়কের মাদাম ব্রিজ, মন্দারী বাজার ব্রিজ ও চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম বাজার ব্রিজ ভেঙে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেই স্মৃতি হিসেবে মাদাম ব্রিজের পিলারগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
বইটিতে উল্লেখ আছে, পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ এপ্রিল লক্ষ্মীপুর সদরে ঢুকে বাজারডিতে সার্কেল অফিসারের কার্যালয় ও বাসভবনে প্রধান ক্যাম্প স্থাপন করে। ওই দিনই মজপুর গ্রামে হামলা চালায় এবং ৩৫ জনকে হত্যা করে। লক্ষ্মীপুরের ইতিহাসে এ ঘটনা ‘মজপুর গণহত্যা’ নামে পরিচিত। পরে তারা লক্ষ্মীপুর সদরের বাজারের বটু চৌধুরীর বাড়ি, দালাল বাজার হাইস্কুল, মান্দারী হাইস্কুল, বাজারের বড় মসজিদ, প্রবণাতন হাইস্কুল, পেয়ারাপুর, মজপুর ও আলমপুরে সাব–ক্যাম্প স্থাপন করে।
লক্ষ্মীপুর সদরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দালাল বাজার রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, মান্দারী বাজার রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, প্রতাপগঞ্জ হাইস্কুল আক্রমণ, বড়ালিয়া অপারেশন ইত্যাদি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান (দ্বিতীয় খণ্ড) বইয়ে এমন ১৭টি সম্মুখযুদ্ধের তথ্য দেওয়া আছে।
৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্পে রাজাকারদের রেখে কৌশলে নোয়াখালীর চৌমুহনীর দিকে পালিয়ে যায়। ৪ ডিসেম্বর সকালে সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই মুক্তির আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়েন লক্ষ্মীপুরের মানুষ।
নভেম্বরের দিকে সম্মুখযুদ্ধ বাড়তে থাকে। সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে স্থানীয় দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুল আলম ও খোরশেদ আলম পাটোয়ারী (ফিরোজ) বলেন, নভেম্বর থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী ক্রমে কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল। তারা সীমিতভাবে চলাফেরা করত এবং অবস্থান ছিল শুধুমাত্র বাগবাড়ির মাদাম ও থানার ক্যাম্পে।
২ ডিসেম্বর রাতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা রফিকুল হায়দার চৌধুরী, আক্তারুজ্জামান ও সুবেদার আবদুল মতিনের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনীর দুই ক্যাম্প ঘিরে ফেলেন। ৩ ডিসেম্বর ভোরের আলো ফুটতেই পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু তারা রাজি হয়নি। তারপর শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। সেদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত টানা বন্দুকের শব্দ, মর্টারের বিস্ফোরণ এবং আকাশজুড়ে কালো ধোঁয়া ছিল।
ওই বিকেলে লক্ষ্মীপুরে দেখা যায় অভূতপূর্ব এক দৃশ্য। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়াতে এলাকার হাজার হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। হাতে লাঠি, বাঁশ, কাস্তে—যা পেয়েছেন, তা নিয়েই ছুটে এসেছেন তাঁরা। মনে হচ্ছিল, আর কোনো শক্তিই বিজয় আটকে রাখতে পারবে না।
আসলেই তা ঘটেছিল। ৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্পে রাজাকারদের রেখে কৌশলে নোয়াখালীর চৌমুহনীর দিকে পালিয়ে যায়। ৪ ডিসেম্বর সকালে সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই লক্ষ্মীপুরের মানুষ মুক্তির আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়েন। রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
মাহবুবুল আলম ও খোরশেদ আলম সেই সময়কার লড়াই ও বিজয়ের কথা বলার পাশাপাশি একটি বেদনার কথাও জানান। জেলার রাজাকার কমান্ডার আবদুল হাইয়ের নেতৃত্বে ওই দিন রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালানো হয়। তখন মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ মারা যান এবং আরও তিনজন আহত হন। এভাবেই আনন্দ–বেদনায় রচিত হয় বিজয়।

Comments
Comments