মোনাজাতউদ্দিনের প্রতিবেদনের সেই কোহিনুরের খবর কী
![]() |
| কোহিনুর এখন পাটজাতীয় পণ্য তৈরি করেন এবং প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
‘পায়রাবন্দের প্রতিটি মৌজা ও গ্রামে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। সাত বছর আগে গ্রাম জরিপকালে শখানেক মেয়ে কিংবা ছেলে পেয়েছিলাম, যাদের বাল্যবিবাহ হয়েছে। ’৯২ সালের মার্চে গোটা ত্রিশেক ঘটনার কথা জানতে পারি। এগুলোর মধ্যে কোহিনুর ও শহীদুলের (প্রকৃত নাম শাহীদুল) বিয়ের ঘটনাটি আমাকে বিশেষভাবে নাড়া দেয়। নিজেদের কোনো ছেলে হয়নি বলে নাবালিকা কোহিনুরের বিয়ে দিয়েছিল ওর মা–বাবা।’
এই কথাগুলো ‘পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ’ বইয়ে লিখেছেন চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন। সাত বছর বয়সে কোহিনুরের বিয়ে হয়। তখন সে পায়রাবন্দ প্রাইমারি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ নারী জাগরণ ও নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মস্থান। এই পায়রাবন্দে শিশু-বাল্যবিবাহ, অসম বিবাহ, যৌতুক ও নির্যাতনের মতো বাস্তব ঘটনা নিয়ে লেখা মোনাজাতউদ্দিনের সেই সময়ের প্রতিবেদন ও বই আলোচনায় আসে। সেই সঙ্গে আলোচনায় আসেন কোহিনুরও।
কোহিনুর এখন কেমন আছেন, তা জানতে ৭ ডিসেম্বর তাঁর পরিবারের কাছে যাওয়া হয়। রংপুর থেকে মডার্ন হয়ে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রে যাওয়ার পথে জয়রামপুর আনোয়ার গ্রাম। এই গ্রামেই সড়কের পাশে কোহিনুরের বাবা খলিলুর রহমান (৭০) একটি গালামালের দোকান করেন। সেখানে গেলে কোহিনুরের মা আছিরন নেছা (৭০) দোকানসংলগ্ন তাঁদের ‘অনেক আশা মহিলা কুটির শিল্প মহিলা সমিতি’র প্রদর্শনী কেন্দ্রে বসতে দেন। কিছুক্ষণ পর সেখানে আসেন কোহিনুর। তাঁর শ্বশুরবাড়ি ও বাবার বাড়ি পাশাপাশি।
কোহিনুরের বয়স এখন ৪০ বছর। তাঁর তিন ছেলে। স্বামী শাহীদুল ইসলাম কৃষিকাজ করেন। পাশাপাশি গরু-বাছুর দেখাশোনা করেন, আর মাঝেমধ্যে রিকশাও চালান। কোহিনুর বলেন, ‘জীবন মানে যুদ্ধ। যাঁদের কিছু থাকে না, তাঁদের প্রতিদিন যুদ্ধ করেই চলতে হয়।’
কথা প্রসঙ্গে জানা যায়, কোহিনুর তাঁর মায়ের কাছ থেকে পাটজাতীয় দ্রব্য দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি শিখেছেন। এখন তিনি প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। তবে পড়াশোনা করতে না পারার আক্ষেপ রয়েছে তাঁর। কোহিনুর বলেন, ‘আমার মা আমাকে সব সময় সমর্থন দিয়েছেন। কোনো কাজে কখনো বাধা দেননি। শুধু একটাই ভুল করেছেন, ছোট বয়সে আমার বিয়ে দিয়েছেন। এরপরও লেখাপড়া করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলত, “ও তো লেখাপড়া করে কী হবে?” ১২ বছর বয়সে যেদিন ছেলেটার জন্ম হলো, সেদিনই আমার লেখাপড়া শেষ হয়ে গেল।’
কোহিনুর জানান, কোনো প্রকল্পে প্রশিক্ষক পদে আবেদন করলে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ চাওয়া হয়। তা দিতে না পারায় অনেক সময় কাজ পান না। তিনি বলেন, ‘একটা লেখাপড়ার সার্টিফিকেটের কারণেই আমি আটকে যাই। এই জন্য আমাকে নেওয়া হয় না। বিভিন্ন মিটিংয়ে গেলে অনেকেই ইংরেজিতে কথা বলেন। আমি পারি না। লেখাপড়ার জায়গায় আমি পিছিয়ে, কিন্তু কাজের জায়গায় আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না।’
আর্থিক সংকটের মধ্যেও কোহিনুর তাঁর তিন ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। বড় ছেলে নূর মোহাম্মদ ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে বর্তমানে একটি এনজিওতে চাকরি করছেন। মেজ ছেলে এইচএসসিতে পড়ছে। ছোট ছেলে লিটন অষ্টম শ্রেণিতে। তাঁর বড় দুই ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করলেও কোহিনুর চান, তাঁরা পড়াশোনা চালিয়ে যাক।
![]() |
| চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন | গ্রাফিক্স: পদ্মা ট্রিবিউন |
পড়াশোনার প্রতি নিজের ‘অদম্য’ ইচ্ছার কথাও জানান কোহিনুর। তিনি বলেন, ‘বেগম রোকেয়ার সময় মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ ছিল না। বইয়ে পড়েছি, তিনি মোমবাতির আলো জ্বালিয়ে রাতে ভাইয়ের কাছে পড়তেন। তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে আটজন নারীকে প্রস্তুত করেছিলেন স্কুল খোলার জন্য। আমি এখনো পড়ি। লেখাপড়া ছাড়া কিছু হয় না। উন্মুক্তে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কাজের চাপে আর হয়ে ওঠেনি।’
![]() |
| ‘পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ’ বইয়ের প্রচ্ছদ। এতে পায়রাবন্দে শিশু-বাল্যবিবাহ, অসম বিবাহ, যৌতুক, নির্যাতনসহ বাস্তব ঘটনা নিয়ে মোনাজাতউদ্দিনের বিভিন্ন প্রতিবেদন স্থান পেয়েছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
৭ বছরের মেয়ে কোহিনুরকে বিয়ে দেওয়ার পেছনে আছিরন-খলিলুর দম্পতির চরম দারিদ্র্যও বড় কারণ ছিল। মোনাজাতউদ্দিন লেখেন, ‘খলিলুর রহমান আগে ছিলেন ক্ষুদ্র কৃষক। জমি হারিয়ে পরে দিনমজুর হন। কিন্তু একদিকে মজুরি কম, অন্যদিকে কাজও নিয়মিত পাওয়া যেত না। ধারদেনা করে একটি পুরোনো রিকশা কিনে কিছুদিন চালান। হঠাৎ একদিন পেটের ব্যথা শুরু হয়। অসহ্য যন্ত্রণায় পথের মাঝেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এরপর শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। ডাক্তারের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পেটের ব্যথার কারণ কী, কিংবা আসলে রোগটা কী, কিছুই জানা হয়নি।’
তবে আছিরনের অবস্থা এখন আর সেই রকম নেই। নিজের পরিশ্রমে তিনি ভাগ্য বদলেছেন। দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে পাটজাত পণ্য তৈরি করেন। গ্রামের নারীদেরও তিনি এই কাজে প্রশিক্ষণ দেন। পায়রাবন্দসহ সাতটি গ্রামের ৬০০ নারীকে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মমুখী করেছেন। নিজে হয়েছেন স্বাবলম্বী। পাকা বাড়ি করেছেন। আট শতক জমি কিনে ছোট মেয়েকে বাড়ি করে দিয়েছেন। তাঁর স্বামীও এখন সুস্থ আছেন।
সেই সময়ের কথা তুলে ধরে আছিরন বলেন, ১৯৭৫ সালে তাঁর বিয়ে হয়। ১৯৭৭ সাল থেকে তাঁর স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন। পেটের ব্যথার কারণে তিনি কাজ করতে পারতেন না। তাঁদের দুই মেয়ে। আছিরন বলেন, ‘৭ বছর বয়সে কোহিনুরকে বিয়ে দিছি। একটা চিন্তা করেই বিয়ে দিছি। স্বামী অসুস্থ। বাজারে গিয়ে একটা ওষুধ এনে দেবে, এমন মানুষ আমার নাই। যে জামাইটার সঙ্গে বিয়ে দিছি, সে ছেলেটাও এতিম। ছেলেটা সব সময় আমার কাছেই থাকত। ওই কারণে অনুভব করি, বিয়েটা দিছি। ছেলেটা যখন কাছে আছে, আমারও তো একজন মানুষের অভাব। ওই ছেলে যদি কাছে থাকে, তাহলে সুবিধা হবে।’
![]() |
| কোহিনুর মায়ের কাছ থেকে পাটজাতীয় দ্রব্য থেকে পণ্য তৈরি শিখেছেন। তিনি এখন প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। সম্প্রতি রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
তবে সাত বছরের মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর খুব ভয়ে ছিলেন বলে জানান কোহিনুরের বাবা খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘তখন আমার ওপর দিয়ে খুব ঝড়-তুফান গেছে। মোনাজাত ভাই রোজই আসতেন। এসব কথা শুনতেন আর লিখতেন। একটা ইতিহাসের বইও বের হয়েছিল’—পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদের কথা উল্লেখ করেন তিনি। খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমি খুব ভয় করতাম, জেল হয় কি না। ছোট মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। তবে একটা কারণে আমার কিছু হয়নি। আমার পেটের ব্যথা ছিল। বাঁচি না মরি, সেই অবস্থায় ছিলাম বলেই।’
তবে আছিরন ও খলিলুর এখন আর কেউ চান না, ১৮ বছরের নিচে কোনো মেয়ের বিয়ে দিতে। আছিরন বলেন, তাঁর ছোট মেয়ে গোলেনুরের বিয়ে দিয়েছেন ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর।
মোনাজাতউদ্দিন যখন পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদের জন্য তথ্য সংগ্রহ করছিলেন, সে সময় তাঁকে সহযোগিতা করেন বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম (দুলাল)। তিনি বলেন, ওই সময় পরিবারটি খুবই অসহায় ছিল। এখন সেই অবস্থা বদলে গেছে। পায়রাবন্দেও নারীশিক্ষার অগ্রগতি হয়েছে। এখন আর শিশু বিবাহের প্রচলন নেই। তবে এসব বাস্তব চিত্র তুলে ধরে চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন।




Comments
Comments