নিয়ম ভেঙে প্রচারণা, ঢাকার রাস্তায় পোস্টার–বিলবোর্ডের ছড়াছড়ি
| রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণার জন্য বিলবোর্ড, পোস্টার ও ফেস্টুন দেখা যাচ্ছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিয়ম অমান্য করে প্রচারণা চালাচ্ছেন বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এবার নির্বাচনে পোস্টার ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও রাজধানীতে বিদ্যুতের পোল, মেট্রোরেলের পিলার, ভবনের দেয়াল ও গাছপালা ইতোমধ্যেই পোস্টারে ভর্তি। এছাড়া বিলবোর্ড, ফেস্টুন ও ব্যানার লাগিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বে থাকা দুই সিটি করপোরেশন এ বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেই দায়িত্ব পালন করেছে। কয়েকদিন নামমাত্র অভিযান চালানো হলেও পরিস্থিতিতে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) জানিয়েছে, আচরণবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তফশীল ঘোষণার পর তারা কাজ শুরু করেছেন।
গত নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইসি নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, প্রার্থীরা ২০টি করে বিলবোর্ড স্থাপন করে প্রচারণা চালাতে পারবেন। এছাড়া লিফলেট ও ফেস্টুন ব্যবহারের সুযোগও আছে। তবে কোনো পোস্টার ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু দেখা গেছে, কিছু প্রার্থী তফশীল ঘোষণার আগেই ২০টির বেশি বিলবোর্ড বসিয়ে দিয়েছেন। পোস্টারও আছে চারদিকে। এই ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণসংহতি আন্দোলন ও এনসিপির প্রার্থীরা। এছাড়া রিপাবলিকান পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীর প্রচারণাও চোখে পড়ছে।
পল্টন মোড়ে ট্রপিকানা টাওয়ারের সামনে দেখা যায়, ঢাকা-৮ আসনের বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী মির্জা আব্বাসের পক্ষে বিশাল বিলবোর্ড। ‘তারুণ্যের প্রথম ভোট ধানের শীষের পক্ষে হোক’ এমন স্লোগান সংবলিত আরও কয়েকটি মাঝারি বিলবোর্ড আছে পল্টন মোড়, তোপখানা রোড, সেগুনবাগিচা, জাতীয় প্রেস ক্লাব, বিজয়নগর, কাকরাইল, নয়াপল্টন ও শাহবাগ এলাকায়। পুরো এলাকা ছেয়ে গেছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনে। আব্বাস সমর্থক বিএনপির থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের লাগানো প্রতিটি বিলবোর্ড, ব্যানার ও ফেস্টুনে ভোট ও দোয়াপ্রার্থী হিসেবে ‘ঢাকা-৮ আসনের সর্বস্তরের জনগণ’-এর কথা বলা হয়েছে।
ঢাকা-৮ আসনের জামায়াতে ইসলামী দলের সম্ভাব্য প্রার্থী ড. মো. হেলাল উদ্দিনের পক্ষে বিশাল বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও নায়েবে আমির হেলালের পক্ষে বেশ কয়েকটি বিলবোর্ড টানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী হতে আগ্রহী শাহবাগ (পূর্ব) থানা জামায়াতে ইসলামীর আমির আহসান হাবীব। সেগুলোতে সংসদ প্রার্থী হেলালের সমানাকৃতির ছবি রয়েছে আহসান হাবীবের। অনেকে বলছেন, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের প্রচারণার সুযোগে ভবিষ্যতে নিজের কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের প্রচারণা এগিয়ে রাখছেন আহসান হাবীব। এই আসনের পুরো এলাকায় জামায়াত প্রার্থীর পক্ষে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড আছে।
বিলবোর্ডের প্রচারণায় পিছিয়ে নেই একই আসনের ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুফতি কেফায়েতুল্লাহ কাশফীও। পল্টন মোড় এলাকায় তাঁর হাতপাখা প্রতীকের পক্ষে ভোট চেয়ে অন্তত পাঁচটি বিলবোর্ড আছে। এছাড়া তাঁর পক্ষে অসংখ্য ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার ঝোলানো হয়েছে বিভিন্ন স্থানে।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের পক্ষে প্রচারের বিলবোর্ড শোভা পাচ্ছে পল্টন মোড়ে, মতিঝিলমুখী সড়কের শুরুতেই। তাঁর ‘কোদাল’ মার্কার পক্ষে ভোট চেয়ে ছোট-বড় পোস্টার, ব্যানার, বিলবোর্ড ও ফেস্টুন আশপাশের এলাকাগুলোতে লাগানো হয়েছে। পল্টন মোড়ের কাছেই রয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) মনোনীত ত্রিদিব কুমার সাহার বিশাল বিলবোর্ড। দলের কাস্তে মার্কার পক্ষে লাগানো বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারে লেখা আছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষায় গণমানুষের ঐক্য ও সংগ্রাম গড়ে তুলুন’। একই সঙ্গে ‘বৈষম্যহীন বামপন্থি-গণতান্ত্রিক শক্তির সরকার’ গঠনের আহ্বানও জানানো হয়েছে।
এছাড়া ঢাকা-৮ আসন থেকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সম্ভাব্য প্রার্থী কাজী ফখরুল ইসলাম (শাপলা কলি প্রতীক) এবং বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-বাংলাদেশ জাসদ মনোনীত প্রার্থী এ এফ এম ইসমাইল চৌধুরীর (মোটর গাড়ি প্রতীক) পক্ষে পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন বিভিন্ন এলাকায় দেখা যাচ্ছে।
বিধি অনুযায়ী নির্বাচনের তফশীল ঘোষণার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সম্ভাব্য সব প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের এসব বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার অপসারণ করতে হবে। তফশীল ঘোষণার অনেক আগে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে মির্জা আব্বাসের পক্ষে প্রচারণা চালানোর বিষয়ে জানতে চাইলে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পল্টন থানা বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘প্রচারণায় এগিয়ে থাকার জন্যই আমরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছি। তফশীল ঘোষণার পর এগুলো অপসারণ করতে হবে। তারপরও প্রচারণা চালানোই হলো লক্ষ্য।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী ও সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা সবসময় নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলার দাবি জানাই। আমরা এলাকাবাসী বা অন্য নেতার মতো করে ব্যানার, বিলবোর্ড লাগাইনি। আমাদের দলের বিভিন্ন ইউনিট থেকে এগুলো লাগানো হয়েছে। তবে কোনো নিয়ম ভঙ্গ হয়নি। তফশীল ঘোষণার পর আর কোনো নতুন লাগানো হবে না।’ তিনি আরও বলেন, তফশীল ঘোষণার পর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তারা নিজ উদ্যোগে পোস্টার অপসারণ করবেন।
এদিকে সংসদ ভবন, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার এলাকায় সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে ঢাকা-১২ আসনে বিএনপির প্রার্থী সাইফুল আলম নিরব, জামায়াতের প্রার্থী সাইফুল আলম খান মিলন ও গণসংহতি আন্দোলনের তাসলিমা আক্তারের বিলবোর্ড, ব্যানার ও পোস্টার। জামায়াত ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রচারণায় কেবল এলাকার লোক বা শুভাকাঙ্ক্ষীর নাম উল্লেখ নেই। বিজয় সরণি থেকে তেজগাঁও ফ্লাইওভারের প্রবেশ পথেও দুটি বিলবোর্ড পাশাপাশি বাঁশের খুটিতে লাগানো হয়েছে। গণসংহতি আন্দোলনের তাসলিমা আক্তারের প্রচারণায় মাথাল প্রতীক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও দলের সভাপতি-সম্পাদকের ছবি এবং নিজের বড় ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। বিলবোর্ডে লেখা আছে, ‘আপনার ভোট পরিবর্তন ও গণমানুষের পক্ষে হোক’।
খামারবাড়ি সংলগ্ন সংসদ ভবনের পাশের সড়কদ্বীপ প্রার্থীদের ব্যানার-বিলবোর্ডে ঢেকে গেছে। ফার্মগেট থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত কোনো ভবনের সীমানা দেয়াল বা খুঁটিই খালি নেই। সবকিছুই প্রার্থীদের পোস্টারে ভর্তি।
ঢাকা-১২ আসনের প্রার্থী সাইফুল আলম নিরব বলেন, এসব বিলবোর্ড তাঁর দলের কর্মীরা উৎসাহ নিয়ে লাগিয়েছেন। নির্বাচনী আচরণবিধিতে এসব লাগানোর নিয়ম না থাকলে কমিশন এগুলো খুলে দিতে পারে। তফশীল ঘোষণার পর প্রচারণা চালাতে বাধা নেই।
অনুমোদনহীন বিলবোর্ড, পোস্টার ও ব্যানার না লাগানোর জন্য ৪ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। এতে বলা হয়েছে, ডিএসসিসি এলাকায় সম্প্রতি করপোরেশনের অনুমতি ছাড়া বিভিন্ন স্থানে ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার, বিজ্ঞাপন, সাইনবোর্ড ও নির্বাচনী প্রচারণার প্রচারপত্র স্থাপন করা হয়েছে। এটি ‘দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২’-এর পরিপন্থি। একটি পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর নগরী গড়ে তোলার জন্য ডিএসসিসি অনুমোদন ছাড়া সব ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার, বিজ্ঞাপন, সাইনবোর্ড ও নির্বাচনী প্রচারপত্র অপসারণের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করেছে। অন্যথায় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়া ১৮ নভেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) অনুরূপ গণবিজ্ঞপ্তি দেয়। সাত দিনের মধ্যে নিজ উদ্যোগে ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার অপসারণ না করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। পরে দু-একদিন নামমাত্র কিছু অপসারণ করা হলেও শাস্তির কোনো নজির দেখা যায়নি। ৮ ডিসেম্বর ডিএসসিসি সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় অভিযান চালিয়ে কয়েকটি অপসারণ করেছে। এরপর তেমন কিছু লক্ষ্য করা যায়নি। ডিএসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মাহবুবুর রহমান তালুকদার বলেন, গত কয়েক দিনে পাঁচ শতাধিক অবৈধ ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণ করা হয়েছে। যাঁরা সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থান ছাড়া যেকোনো জায়গায় ব্যানার, পোস্টার বা বিলবোর্ড লাগিয়ে শহরকে অপরিচ্ছন্ন করবেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
Comments
Comments